মতামত

বিএনপিকে কাছে টানার চেষ্টা, কফি পান ও ফুলের মালা

নির্বাচন সামনে রেখে যখন এক পক্ষ ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে, আরেক পক্ষ তাদের ভোটকেন্দ্রে না আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে, তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামালউদ্দিন আহমদই সঠিক কথাটি বলেছেন।

বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া ও ভোট প্রদানে বাধ্য করা—দুটিই মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

তাঁর ভাষায়, ‘বিশ্বের কোনো কোনো দেশ আছে, যেখানে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক, যেমন নিউজিল্যান্ড। কিন্তু আমাদের দেশে সে ধরনের নিয়ম নেই, সে কারণে আমি বলব, কেউ যদি ভোট না দিতে যায়, তাহলে সেটা তার ইচ্ছা। কিন্তু কেউ যদি দিতে চায়, তাকে বাধা দেওয়াও অনুচিত, আইনের বরখেলাপ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। একই সঙ্গে কাউকে যদি ভোট দিতে বাধ্য করা হয়, তা মানবাধিকার লঙ্ঘন।’ (ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩)

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বাছাই কিংবা আগামী পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ নামের প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। কিন্তু হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদ ও আয়ের যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে জনগণের মালিকানা আর অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। যাঁরা জনগণের সেবক বলে দাবি করেন, তাঁরাই এখন দেশের মালিক হয়ে গেছেন। 

বিএনপি না আসায় আগামী ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে, তাতে প্রার্থী বাছাই করার সুযোগ খুবই সীমিত। ফলে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা–৮ আসনের প্রার্থী বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ঢাকায় ভোটারদের কেন্দ্রে আসার প্রবণতা একটু কম। এটি বিবেচনায় নিয়ে আমরা ভোট চাওয়া ও কেন্দ্রে ভোটার আনার কাজকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছি। আগে বলতাম ভাই ভোটটা দেবেন, এখন আমরা বলি ভোটকেন্দ্রে দয়া করে আসবেন।’ (প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩) 

অতীতে অনেক নির্বাচনে দেখা যেত, যে প্রার্থী মনে করতেন, কোনো এলাকার লোকজন তাঁকে ভোট দেবেন না, তিনি তাঁদের কাছে গিয়ে বলতেন, ‘ভাই, আপনারা যেহেতু আমাকেই সমর্থন করছেন, সেহেতু আমি আপনাদের ভোট পেয়ে গেছি। কষ্ট করে আপনাদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’ এই বক্তব্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি থাকত এবং ওই এলাকার মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে সাহস পেতেন না।

এবার ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের যাওয়ার অর্থ হলো ক্ষমতাসীনদের জয় নিশ্চিত হওয়া। যেখানে নৌকা প্রার্থীর বিপরীতে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে, সেখানেও নৌকার প্রার্থী পরাজিত হলে দল জয়ী হবে। যিনি নৌকা নিয়ে লড়ছেন আর যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল, কাঁচি বা অন্য প্রতীক নিয়ে লড়ছেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা।

এসব আসনে ভোটার টানা কঠিন হবে না বলে মনে করেন প্রার্থীরা। কিন্তু সমস্যা হবে, যেখানে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীর বদলে কিংস পার্টির কিংবা সহযোগী পার্টির প্রায় নিষ্ক্রিয় প্রার্থীরা থাকবেন। সেখানে লড়াইটা হবে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কিংবা ব্রাজিলের ফুটবল টিমের সঙ্গে ঢাকার কোনো মহল্লার টিমের মতো। 

কথায় বলে ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’। কোথাও আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে বিএনপির নেতাদের প্রশংসা করেন, কোথাও বিএনপির নেতার গলায় মালা দেন। রাজশাহী–১ আসনের নৌকার প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরী ফুলের মালা দিয়েছেন বিএনপির নেতা মোজাম্মেল হকের গলায়।

কামালউদ্দিন আহমেদ নিউজিল্যান্ডের বাধ্যতামূলক ভোটের কথা বলেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভোট না দিলে নাগরিককে জরিমানা গুনতে হয়। এমনকি ভোটার হাসপাতালে থাকলেও নির্বাচনী কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে ভোটারদের ভোট নিয়ে আসেন। আবার অনেক পশ্চিমা দেশে ভোট দেওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের আগ্রহ কম। সেখানে ২৫ বা ৩০ শতাংশ ভোট পড়লেই সেটাকে পপুলার ভোট ধরা হয়।

কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন ভোটকে নেন উৎসব হিসেবে। পাঁচ বছর পরপর সেই উৎসবে তাঁরা শামিল হতে চান। সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৮২, ৭৪ দশমিক ৯৭ ও ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। এই তিন নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ধরাশায়ী হয়েছেন। এরপর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, কোনোটিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়নি ক্ষমতাসীনদের।

কিন্তু আমাদের দেশের লোকজন ভোটকে নেন উৎসব হিসেবে। পাঁচ বছর পরপর সেই উৎসবে তাঁরা শামিল হতে চান। সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৮২, ৭৪ দশমিক ৯৭ ও ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এই তিন নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ধরাশায়ী হয়েছেন। এরপর যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, কোনোটিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়নি ক্ষমতাসীনদের।

এ প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোটাররা কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন? এক পক্ষ বলছে, ভোট দিতে কেন্দ্রে আসুন। আরেক পক্ষ বলছে, ভোট বর্জন করুন। যাঁরা যে দলের কর্মী–সমর্থক, তাঁরা নেতৃত্বের আদেশ ও আহ্বানকে মান্য করবেন বলে আশা করি। কিন্তু যাঁরা দলীয় বৃত্তের বাইরের মানুষ, তাঁরা কী করবেন? তাঁরা আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবেন বলে মনে হয় না। আবার বিএনপির ডাক শুনে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। 

জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্ব সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হলেও অনেক প্রার্থী তলেতলে শত্রুকে বন্ধু হিসেবে কাছে টানতে চেষ্টা করছেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

প্রথম আলোয় মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের যে সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মৃণাল কান্তি দাসের পাশে আওয়ামী লীগের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না। মুন্সিগঞ্জ জেলা, উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের পুরো কমিটি কাজ করছে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল ওরফে বিপ্লবের পক্ষে। ২০১১ সালে পৌর নির্বাচনে মোহাম্মদ ফয়সালের বিপক্ষে ছিলেন মৃণাল কান্তি দাস। এর পর থেকে সেখানকার আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। 

এই অবস্থায় নির্বাচনে জিততে হলে তাঁকে দলের বাইরের সমর্থন পেতে হবে। দলের বাইরের সমর্থন, মানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমর্থন। গত শনিবার এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে মৃণাল কান্তি দাস বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল হাই, তাঁর ভাই মহিউদ্দিন এবং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি এলাকার বিএনপির সমর্থকদেরও ভোট চেয়েছেন।

কথায় বলে ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’। কোথাও আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারাতে বিএনপির নেতাদের প্রশংসা করেন, কোথাও বিএনপির নেতার গলায় মালা দেন। রাজশাহী–১ আসনের নৌকার প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরী ফুলের মালা দিয়েছেন বিএনপির নেতা মোজাম্মেল হকের গলায়। আবার মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন ওমর ফারুক চৌধুরীর পক্ষে ভোট প্রার্থনা করে চলেছেন। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘রাজশাহীতে নৌকার ভোট চাইলেন বিএনপির এক নেতা, চারজন বহিষ্কার।’

এদিকে ২৬ ডিসেম্বরের পত্রিকায় আরেকটি চমকপ্রদ খবর। রাজশাহী-২ আসনে ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু গত শনিবার সন্ধ্যায় নগরের একটি হোটেলে একসঙ্গে কফি পান করেন। 

মৃণাল কান্তি দাসের বিএনপিকে কাছে টানা কিংবা মিনু-বাদশার কফিপান ভোটের মাঠে আদৌ প্রভাব ফেলে কি না, জানার জন্য ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com