শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হয়
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হয়

মতামত

এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করায় যেসব সংকট হতে পারে

এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল জুন মাসের ৩০ তারিখে। জুলাইয়ের ১৬ তারিখ পর্যন্ত পরীক্ষা ঠিকমতোই হয়েছে। এরপর প্রথমে ১৮ জুলাইয়ের পরীক্ষা এবং পরে ২১, ২৩ ও ২৫ জুলাইয়ের পরীক্ষা স্থগিত হয়। মাঝখানে সরকার পরিবর্তনের মতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে।

বিভিন্ন থানায় হামলার কারণে সেখানকার প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে বাকি পরীক্ষাগুলোর তারিখ বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়। সম্প্রতি নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় আগামী ১১ সেপ্টেম্বর।

এর মধ্যে একদল শিক্ষার্থী স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ২০ আগস্ট সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভবনের নিচে একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন।

এর আগে ওই দিন দুপুরে শিক্ষা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা অর্ধেক নম্বরে হবে এবং পরীক্ষার তারিখও ১১ সেপ্টেম্বর থেকে আরও ২ সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে। কিন্তু সচিবালয়ে যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করছিলেন, তাঁরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি।

আন্দোলনের মুখে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রায় বাধ্য হয়েই স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল ঘোষণা করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অনেক পরীক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কেউ কেউ এখনো হাসপাতালে ভর্তি। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তাঁরা মানসিক চাপে আছেন।

মোট কথা, পরীক্ষায় বসার মতো শারীরিক-মানসিক অবস্থায় তাঁরা নেই। এ অবস্থায় বিকল্প উপায়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের দাবির পেছনের যুক্তিগুলো নিঃসন্দেহে বিবেচনায় নেওয়ার মতো।

বিকল্প উপায় কী হতে পারে, সেটিও বাতলে দিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়ে গেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে খাতা মূল্যায়ন করে নম্বর দেওয়া যায়। বাকি বিষয়গুলোর জন্য এসএসসির ফলাফলের সঙ্গে সমন্বয় করে জিপিএ নির্ধারণ করা যেতে পারে।

আপৎকালে এভাবে ফলাফল নির্ধারণের নজির আগেও ঘটেছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। তখন এসএসসি, জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে একধরনের গড় মূল্যায়ন করে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা এর পরবর্তী সংকট নিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। যেমন ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সবাই পাস করেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হলে এবারও প্রায় শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করবেন। এর ফলে সমস্যা তৈরি হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। যদিও ধারণা করা যায়, এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না। তবে নীতিগতভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সবার জন্যই রাখতে হয়।

তবে এ জন্য তখন জাতীয় সংসদে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশ করতে আইন পাস হয়। এর আগে আইন ছিল পরীক্ষা নিয়েই ফল প্রকাশ করতে হবে। সংশোধিত আইনে বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে অতিমারি, মহামারির কারণে বা সরকার নির্ধারিত সময়ে কোনো অনিবার্য পরিস্থিতিতে কোনো পরীক্ষা গ্রহণ, ফল প্রকাশ ও সনদ প্রদান করা সম্ভব না হলে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত আদেশে কোনো বিশেষ বছরে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ছাড়াই বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা গ্রহণ করে মূল্যায়ন, ফল প্রকাশ ও সনদ প্রদান করা যাবে।

বর্তমান অন্তবর্তী সরকার যেহেতু সংবিধান ও আগের সব আইন রহিত করেনি, সুতরাং বিদ্যমান আইনেই এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু স্থগিত পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত আসার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এটি যে মন্দ নজির হয়ে থাকবে, সেটি মনে করেন অনেকে। পরবর্তী চাকরিজীবনেও এসব শিক্ষার্থীকে ভুগতে হতে পারে। এবারের ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন সমন্বয়কও বলেছেন, পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিলের বিষয়টি তাঁরা সমর্থন করেন না।

পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে যাঁরা, তাঁরা এর পরবর্তী সংকট নিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। যেমন ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সবাই পাস করেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হলে এবারও প্রায় শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করবেন। এর ফলে সমস্যা তৈরি হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। যদিও ধারণা করা যায়, এইচএসসি পাস করা সব শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন না। তবে নীতিগতভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সবার জন্যই রাখতে হয়।

এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তিপ্রক্রিয়া নির্ভর করে। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব পরীক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে পারে না। এ বছর সাড়ে ১৪ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।

দেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট আসন রয়েছে ১৩ লাখের মতো। ফলে, সব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না–ও পেতে পারেন। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বহু কলেজ আছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পেলেও পড়াশোনা করতে আগ্রহী হন না।

এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলোর নম্বর অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাবটি তাই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নম্বরকে দ্বিগুণ করে ১০০–এর মধ্যে বিষয়গত জিপিএ নির্ধারণ করা যায়।

প্রয়োজনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েবসাইটে পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে পরীক্ষার্থীদের মনোভাব বোঝার জন্য একটি জরিপ চালাতে পারে। জরিপের ফলের ভিত্তিতে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনটি করা গেলে অন্তত অনেক দায় ও অভিযোগ থেকে তারা মুক্ত থাকতে পারে।

আমার ধারণা, অধিকাংশ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। আর এ ক্ষেত্রে পরবর্তী পরীক্ষাগুলোর জন্য অন্তত এক মাস হাতে সময় দিতে হবে।

একটু দেরিতে এইচএসসির ফল প্রকাশিত হলেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মতো অবস্থায় সহসা পৌঁছাবে বলে মনে হয় না।

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।