আনিসুল হকের কলাম

ঢেউয়ের মতো আসছে যে খবরগুলো

একেকটা দিন একেকটা দুঃসংবাদ আমাদের ওপরে সূর্যগ্রহণের আঁধারের মতো নেমে আসে। ওই দিনের সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বিষণ্ন আর আকীর্ণ করে রাখে। পরের দিনই ঢেউয়ের মতো এসে আছড়ে পড়ে নতুন দুঃসংবাদ।

আমরা পুরোনো উদ্বেগ, দুঃখ, বেদনা ভুলে নতুন বেদনাকে জায়গা করে দিই। মিলান কুন্ডেরার একটা বইয়ের নাম হলো লেট দ্য ওল্ড ডেড মেক রুম ফর দ্য ইয়ং ডেড। প্রবীণ মৃতরা সরুন, নবীন মৃতদের জায়গা দিতে হবে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে উল্টো কথা, তিনি নতুন দুঃখকেই একটু সরে বসে জায়গা করে দিতে বলছেন পুরোনো দুঃখকে:
‘যে-দুঃখ পুরনো, তাকে কাছে এসে বসতে বলি আজ...
নতুন দুঃখকে বলি যাও
কিছুদিন ঘুরে এসো অন্য কোনো সুখের বাগানে...
এখন এই পুরনো দুঃখকে বসার জায়গা দাও।’
সাম্প্রতিক কতগুলো দুঃসংবাদ।

১. বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। দেশের নিট রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে, জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

২. মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। বাজারে করতে যান, তাঁরা জিনিসপত্রের দাম শোনেন, কেউবা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মাছের বদলে আলু যে কিনবেন, তারও উপায় নেই। কাঁচা মরিচের বদলে কী কেনা যেতে পারে ভেবে চুল ছেঁড়েন। কেউবা বিক্রেতার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করতে থাকেন, পাশের লোকের কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে সব রাগ তার ওপরে ঝাড়েন; আর অভিশাপ দেন! সরকারের নীতিনির্ধারকদের বলি, ছদ্মবেশে একবার যেকোনো কাঁচাবাজারে ঘণ্টা-আধেকের জন্য কান খোলা রেখে ঘোরাঘুরি করুন, মানুষের ক্ষোভ, হতাশা, উপায়হীনতা কোন পর্যায়ে গেছে, একটু আঁচ করতে পারবেন।

৩. ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ঢাকায় বৃষ্টি হলো ভীষণ, চারজন মারা গেল বিদ্যুতের তারে; আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তাঘাট পড়ে রইল অচল হয়ে। মানুষ বিপন্ন, দোকানপাটে পানি ঢুকল, অ্যাম্বুলেন্স পড়ে রইল রাস্তার পানিতে ডুবে; কিন্তু মানুষ সাহায্য চাইবে কার কাছে জানে না। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ছিল না, উদ্ধারকারীরা ছিল না; এমনকি এই রাস্তায় যাবেন না—এ কথা বলার মতো কোথাও কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। এমনকি পরের দিনও ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করার জন্যও কেউ ছিল না।

৪. ডেঙ্গুতে মৃত্যু রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ডেঙ্গুমৃত্যুতে শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এটা নিয়ে কারও কোনো বিকার নেই। ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই।’ যেন সবকিছু স্বাভাবিক।

৫. খেলাপি ঋণের পরিমাণেও বাংলাদেশ রেকর্ড করেছে। ব্যাংক খালি করে অনামা প্রতিষ্ঠান ঋণ নিচ্ছে এবং গায়েব হয়ে যাচ্ছে। যেন ব্যাংক লুট চলছে চলবে, চলছে চলবে।

৬. রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমছে। এর একটা মানে হলো, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকেরা টাকা পাঠানোর পথ বেছে নিয়েছেন। তার বিপরীতে আসলে বাংলাদেশের ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। বৈধ চ্যানেলে এলে বাংলাদেশ ডলার পেত। আমাদের টাকা পাচারকারীরা অভিবাসীদের কাছ থেকে ডলার নিচ্ছেন। বিনিময়ে দেশে টাকা দিচ্ছেন তাঁদের স্বজনদের হাতে। এই টাকার সমপরিমাণ ডলার আসলে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

৭. বাংলাদেশ মাদক আমদানি করে বিদেশে টাকা পাচারকারী দেশের বিশ্বতালিকায় পঞ্চম আর এশিয়াতে প্রথম। ৪৮১ মিলিয়ন ডলার ২০১৭-২১, এই ৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, সিনথেটিক মাদক, ফেনসিডিল আনার জন্য। কী ভীষণ গৌরবের কথা!

৮. বিদেশে টাকা পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে বলেছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

শওকত হোসেন প্রথম আলোয় গত ১০ এপ্রিল লিখেছিলেন, ‘কৌশলপত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অবৈধ অর্থের প্রবাহের বড় উৎস হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের “গ্র্যান্ড” বা মহা দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের সংঘবদ্ধ অপরাধ, যেমন চোরাচালান, মাদক ও মানব পাচার, ব্যাংকঋণ কেলেঙ্কারি ও দ্রুত অবলোপন, জাল-জালিয়াতি, অবৈধভাবে কর্মরতদের বিদেশিদের অর্থ অবৈধভাবে লেনদেন এবং বৈধ আয় হলেও কর ফাঁকি দিয়ে ও প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন লঙ্ঘন করে তা পাচার।’

৯. ঢাকা পৃথিবীর মধ্যে ধীরতম শহরের গৌরবতালিকায় ১ নম্বর স্থান অধিকার করে নিয়েছে।

১০. শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। গবেষণায় বের হয়ে আসে, স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা ঝরে যায়, আবার প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা শিক্ষার্থীদের অনেকে ঠিকভাবে পড়তে পারে না, লিখতে পারে না, অঙ্ক কষতে জানে না। শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২২’-এ আরও উঠে এসেছে—তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতের দক্ষতায় দুর্বল। তাদের গণিতের দক্ষতা তৃতীয় শ্রেণির উপযোগীও নয়। তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়ও দুর্বল। তাদের মানও তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়।

বলছিলাম, নতুন দুঃখ আসে, পুরোনো দুঃখকে ভুলে যাই। দুদিন আগে একটা ছোট ভূমিকম্প হয়ে গেল, আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাদের ভূমিকম্প–বিষয়ক করণীয়গুলো যে করা হয়নি, তা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে। ওপরে যে ১০টা নেতিবাচক খবরের তালিকা দিলাম, তার পরিপ্রেক্ষিতে করাটা হলো কী!

মনে হচ্ছে, দেশে একটাই সমস্যা, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া না-পাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পেলেও সুখে-শান্তিতে জীবন পার করা যায়, আর ওই ভিসা পেলেই কারও জীবনে সুখের নহর বয়ে যায় না। সমস্যাটা ভিসায় নয়, সমস্যাটা নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে মন দেওয়া না-দেওয়ায়।

১. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব তো শ্রীলঙ্কাতেও পড়ল, তারা যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করে দিতে পারে, আমরা কেন পারি না? আমাদের রিজার্ভ কেন শুধু কমে? ২. মূল্যস্ফীতি রোধে ব্যবস্থাটা নিলেন কি?

৩. আবার বৃষ্টি হলে কি পুনরায় ঢাকা ডুবে যাবে? ২১ সেপ্টেম্বরের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য কেউ কি বসেছিলেন? কোনো কমিটি হয়েছে? ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশে আবার পলিথিন ফিরে এল কেন?অন্তত এই একটা ব্যাপারে তো কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে।

৪. ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশকনিধনে একটা সামাজিক আন্দোলনের ডাকও কি সরকার-এনজিও-নাগরিক সমাজ-রাজনৈতিক দল মিলে দিতে পারত না! অন্তত ছাত্রলীগ বা স্কাউটও যদি এলাকা ধরে ধরে নামত, তাহলেও তো বুঝতাম, একটা কিছু হচ্ছে।

৫. খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংক-ডাকাতি চলতে দেওয়া হচ্ছে কেন?

৬. রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য কী করা হচ্ছে, জনগণকে জানাবেন কি?

৭. মাদকের ব্যবসায় রুই-কাতলারা জড়িত। সরকার কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে?

৮. টাকা পাচার কি বন্ধ করবেন? নাকি টাকা পাচারকারীদের দুধকলা দিয়ে পুষবেন?

৯. ঢাকা সচল করতে মেগা প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু সমন্বয় আছে কি? ২০০৬-০৮-এর কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বিজয় সরণি মোড় থেকে তেজগাঁওয়ের দিকে র‌্যাংগসের ভবন ভেঙে ফ্লাইওভার করা হলো। এর কারণে ওই মোড়ে যানজট বেড়েছে। এবার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্যও ওই মোড়ই পার হতে হবে। যেকোনো কর্মদিবসে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে বিজয় সরণির মোড় পার হতে সকাল ৯টায় বের হলে বেলা ১১টার আগে পৌঁছাতে পারবেন? বিচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন প্রকল্প করার আগে সামগ্রিক ফলটা কী হবে, তা ভাবা হবে আর কবে?

১০. সবাই জানি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগই শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমাদের সার্বিক শিক্ষার মান যে শোচনীয়, এটা কি আমরা স্বীকার করে নেব? নিলে কি আমাদের কিছু করণীয় আছে?

মনে হচ্ছে, দেশে একটাই সমস্যা, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া না-পাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না পেলেও সুখে-শান্তিতে জীবন পার করা যায়, আর ওই ভিসা পেলেই কারও জীবনে সুখের নহর বয়ে যায় না। সমস্যাটা ভিসায় নয়, সমস্যাটা নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানে মন দেওয়া না-দেওয়ায়। দেশের মানুষ ভালো থাকলে সবই হবে, ভোটও ভালো হবে, ভিসা নীতিও লাগবে না, তলেতলে আপসও দরকার হবে না। দেশের মানুষকে ভালো রাখুন, তাতে নিজেদের ভালোটাও আসবে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক