দেশের প্রায় ২০ লাখ নারী সকালে উঠে রান্না, ঘর, বাচ্চা আর স্বামী সামলিয়ে কারখানায় যান
দেশের প্রায় ২০ লাখ নারী সকালে উঠে রান্না, ঘর, বাচ্চা আর স্বামী সামলিয়ে কারখানায় যান

নারীতে বিনিয়োগ! বিনিয়োগ মানেই তো মুনাফা

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নারীর সম–অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। বলা হচ্ছে নারীর জন্য বিনিয়োগে গতি পাবে অগ্রগতি।

‘বিনিয়োগ’ শব্দটা নিয়ে আমি জোর আপত্তি তুলব ভাবছিলাম। মানে নারী পণ্য, তাতে বিনিয়োগ করে লাভ তুলে আনতে হবে। আর বিনিয়োগই-বা করবে কে? নারী দিবসের এবারকার প্রতিপাদ্য ‘নারীর সম–অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’ ক্রমাগত কানে লাগছিল আর বাড়ছিল কষ্টের ব্যারোমিটার। মনে মনে অনেক বিচার-আচার করলাম। আমি কি শুধু শুধুই ভুল ভাবছি?

কারণ, ‘নারী’ বিষয়টি আলোচনায় থাকলে, ‘নারী’কে নিয়ে পরিকল্পনার গল্প বললে কিছুটা হলেও বাহবা পাওয়া যায়! নারীকে নিয়ে কতশত পরিসংখ্যান! রীতিমতো হিড়িক। যেমন একটা গবেষণার তথ্য হলো, ৪৩ শতাংশের বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালির কাজে যুক্ত।

পুরুষ ১ শতাংশের কম। দেশের অর্থনীতিতে বাংলাদেশে নারীদের অবদান ২০ শতাংশ। তার ওপর সরকার যদি ঘরোয়া কাজকে স্বীকৃতি দেয় তো জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়ায় প্রায় অর্ধেক। এই স্বীকৃতিতে নাকি পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আসবে!

এত এত আলোচনা, পরিকল্পনা, গবেষণা, সমীক্ষার পরও আসলে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান কোথায়? আমরা এমন সমাজে বাস করি, যে সমাজে জন্মের পর থেকেই মেয়েশিশুরা বৈষম্যের শিকার হয়। আজান দেওয়া থেকে শুরু করে আকিকা—মেয়েশিশু ও ছেলেশিশুর জন্য ভিন্ন বিধান। স্বামী মারা গেলে এই সমাজে নারী পান স্বামীর সম্পত্তির ৮ ভাগের ১ ভাগ। আর স্ত্রী মারা গেলে স্বামী পান স্ত্রীর সম্পত্তির ৪ ভাগের ১ ভাগ।

এখনো পরতে পরতে নারীর প্রতি অন্যায় আর অবিচার। এখনো থেকে থেকে নারীকে ঝুঁকে, নুয়ে থেকে সামলাতে হয় স্বামী আর সংসার। যে যতই প্রতিভাবান হোক না কেন, পতিসেবা থেকে পরিত্রাণ পান খুব কম নারী। সেবা থেকে যাও-বা রেহাই, আপস থেকে নেই বিন্দুমাত্র বিরাম। চুপ থেকে, সব দায়ভার কাঁধে নিয়ে, মুখে কাপড় ঠুসে নারী হন ‘মাতৃরূপী দেবী’।

এই জায়গা থেকে তাঁর বিন্দুমাত্র স্খলন হওয়া চলবে না। যেন সবাইকে আগলে রাখা, সংসারের হাল ধরায় তিনি বাধ্য। দশভুজা দেবী হিসেবে নারীকে চিত্রিত করা গেলে সবার উপকার হয়, নারীকে শোষণ তখন সহজ হয়।

নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ দেশে উপস্থাপন করা হয় তৈরি পোশাকশিল্পের কারিগর নারীদের। কেউ কেউ আবার এমনও মনে করেন, এই নারী কর্মীরা সমাজ-সংসারে গন্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আসলে তাঁদের জীবনযাপন কেমন? এখন দেশের প্রায় ২০ লাখ নারী সকালে উঠে রান্না, ঘর, বাচ্চা আর স্বামী সামলিয়ে কারখানায় যান।

টিফিনের সময় আবার বাইরে অপেক্ষারত স্বামীকে হাতখরচটা ধরিয়ে দিয়ে মেশিনের পেছনে ছোটেন। মাসের শেষে মাইনে পেয়ে বাড়ি, বাচ্চা, স্বামীর পেছনে খরচ করতে করতে নিজের কপালে জোটে না কিছু। তাঁকে নিরন্তর সংসারের কথা, আর পাঁচজনের কথা ভাবতে হয়। যেহেতু নারী সর্বংসহা, তাই তিনি সয়ে যান। সমাজ, রাষ্ট্র তা-ই আশা করে নারীর কাছ থেকে। তিনিও এসব প্রতিষ্ঠানের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে গিয়ে নিজের দিকে তাকানোর ফুরসত পান না।

নারীর জন্য বিনিয়োগ করলে দেশ-জাতি-সমাজ উপকৃত হয়—এ ধারণা যে খুব নতুন, তা-ও নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ কি সত্যি শুধু নারীর উন্নতির জন্য নারীর কথা ভেবে বিনিয়োগ করেছে স্বার্থহীনভাবে? আসলে তাঁদের কথা সমাজ ভাবে না; ব্যাংক ভাবে না; কাছের মানুষও না।

আমার বিবেচনায়, নিজেকে বিলীন করে দিতে দিতে এই নারীর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখনই তো সময় তাঁর ওপর বিনিয়োগ করার। বিশ্বজুড়ে রাজনীতির আর অর্থনীতির ধারক-বাহকেরই তো আজ তাঁকে নিয়ে বাজি ধরবে। যেন নারী একটা পণ্য, যাঁর ওপর মূলধন খাটালে লাভ করার সম্ভাবনা আছে।

আর যারা বিনিয়োগকারী, তারা দেখতে কেমন? বয়স কেমন? প্রতাপ কতখানি? নিশ্চয় এই বিনিয়োগের পরামর্শদাতা একজন পুরুষ! নারী তো নিশ্চয়ই অবলা, অক্ষম! তাই তো তাঁর ওপর বিনিয়োগ করতে হবে, কারণ তিনি নিজে অক্ষম। ভিক্ষার হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই না?

বিনিয়োগে বৈশ্বিক অর্থনীতির চিত্রটা বদলাবে, জিডিপি বাড়বে। সবাই বুক ফুলিয়ে সমতার অহম নিয়ে হাঁটবে এবার! বাহ্! পরিকল্পনাটা কিন্তু চমৎকার।

বিশ্বের সব নারী এক হয়ে পুরুষের ছাদের তলায় গিয়ে নিজের জন্য আবেদন করুন। মিললেও মিলতে পারে কিছু বিনিয়োগ। কিন্তু মনে থাকে যেন, কড়ায়-গন্ডায় শোধ করতে হবে এই ঋণ। বিনিয়োগ মানেই তো মুনাফা। মানেন তো এ কথা?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: নারীর পেছনে ‘বিনিয়োগ’ শব্দটির জায়গায়, যদি নারীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার মতো শব্দ থাকত, তাহলে লেখাটি অন্য রকম হতো।

  • ড. রুবানা হক এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ভাইস চ্যান্সেলর, সাবেক সভাপতি বিজিএমইএ এবং মোহাম্মদী গ্রুপ লিমিটেডের চেয়ারপারসন