অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য দেশের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ৫ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার, যা গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অর্জিত মোট রপ্তানি আয়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি।
বিগত অর্থবছরে অবশ্য মোট রপ্তানি আয় তার আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কোটি ডলার। আর এই কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার ছিল না। বরং বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয় যে গত অর্থবছরের মোট রপ্তানি আয় সেই বছরের ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৯ শতাংশ কম হয়েছে।
পতিত স্বৈরাচারী সরকার বছরের পর বছর কৃত্রিমভাবে রপ্তানি আয়কে ফুলিয়ে দেখিয়েছে আর সে কারণে অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করেছে। অবশেষে যে প্রকৃত রপ্তানি চিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তখন তার সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার বিরাট ব্যবধানও ফুটে উঠেছে। রপ্তানির বিকৃত পরিসংখ্যান দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের পরিসংখ্যানকে যেমন ত্রুটিপূর্ণ করেছে, তেমনি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) উপাত্তকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
অবশ্য এটাও বলতে হয় যে হাসিনা সরকারের শেষ দিকেই রপ্তানি আয়ের কৃত্রিম স্ফীতির বিষয়টি চিহ্নিত হয়। তাতে অবশ্য সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেটা নেওয়ার কথাও নয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে সরবরাহকৃত উপাত্তকে শুল্ক কর্তৃপক্ষের উপাত্তের সঙ্গে মিলিয়ে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিষয়টি ধরা পড়ে।
তখন দেখা যায় যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইপিবির পরিসংখ্যান অনুসারে রপ্তানি আয় ৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার হলেও প্রকৃত আয় হয়েছে ৪ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার। তার মানে প্রকৃত রপ্তানি আয় ওই বছর ১৬ শতাংশ হারে বিকৃতভাবে বাড়ানো হয়েছিল। তা ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার সরবরাহকৃত পণ্য রপ্তানি আয়ের উপাত্তে কিছু ব্যবধান অবশ্য অনেক বছর ধরেই চলে আসছিল। গত এক দশকে তা শুধু বেড়েছে ও বিস্তৃত হয়েছে।
চলতি অর্থবছর পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে বিগত দুই বছরের সংশোধিত উপাত্তকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর যে ৫ হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তার মধ্যে ৫ হাজার কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি থেকে আর বাকি ৭৫০ কোটি ডলার সেবা খাতের রপ্তানি থেকে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, দুই সপ্তাহে আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে তিন বছর মেয়াদি রপ্তানি নীতি ২০২৪-২৭ অনুমোদন দিয়েছে, সেখানে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে গিয়ে বার্ষিক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার কোটি ডলার ধার্য করা হয়েছে। তার মানে তিন বছরে দেশে রপ্তানি আয় দ্বিগুণের বেশি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে, যা একটি অতি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। তা ছাড়া বিগত সরকারের সময় গত মে মাসে অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি যে খসড়া রপ্তানি নীতি অনুমোদন করে গিয়েছিল, সেখানেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। আর সেটা করা হয়েছিল প্রকৃত রপ্তানি আয় কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানো পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে।
ফলে এটা ঠিক স্পষ্ট নয় যে অন্তর্বর্তী সরকার সেই অনুমোদিত খসড়া কীভাবে ও কতটা পর্যালোচনা করেছে ও কী কী সংশোধনী এনে তা অনুমোদন দিয়েছে। এখন পর্যন্ত অনুমোদিত রপ্তানি নীতিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি।
আর বর্তমান বাস্তবতায় এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে যে তিন বছর পরে গিয়ে রপ্তানি আয় উল্লিখিত ১১ হাজার কোটি ডলারে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে না কোনোভাবেই। বরং প্রকৃত রপ্তানি আয় ১০ হাজার কোটি ডলারের নিচে থাকবে। সরল পাটিগণিতেই তা বোঝা যায়।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মোট রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৫ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। যদি বছর শেষে এই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে প্রকৃত আয় ছয় হাজার কোটি ডলারও হয়, তারপর দুই বছরের মাথায় ৬০ শতাংশের বেশি হারে রপ্তানি আয় করতে হবে ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে হলে। আর রপ্তানি নীতির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে হলে মাত্র দুই বছরে প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৮০ শতাংশের বেশি। এর কোনোটিই বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তা সাদা চোখেই বোঝা যায়। প্রশ্ন হলো, এ সহজ অঙ্কটি কি একবারও কষে দেখা হয়নি এ রকম একটি অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলনের বা নির্ধারণের ক্ষেত্রে?
বরং চলতি অর্থবছরের পণ্য রপ্তানি থেকে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের আয় করাই বা কতটা সম্ভব হবে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা উচিত আগে। দেশের বাইরে ও ভেতরে বিরাজমান ও সম্ভাব্য বিভিন্ন অবস্থার গতি-প্রকৃতির ওপরই রপ্তানি আয় নির্ভর করবে।
ইপিবি গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম প্রান্তিকের পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে বিগত দুই অর্থবছরের সংশোধিত পরিসংখ্যানও তুলে ধরেছে।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৩৭ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। এ ক্ষেত্রে বিনিময় হারের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা এ সময়কালে আরও দুর্বল হয়েছে, যা প্রকৃত রপ্তানি আয়কে প্রভাবিত করেছে। অন্যভাবে বললে রপ্তানিতে এ সময়ে তেমন গতি আসেনি।
সেটা আসার কথাও নয়। কারণ, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশ একটা বিরাট ওলটপালটের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, হাজারো লোককে পঙ্গু করেছে, কোটি কোটি মানুষকে মানসিকভাবে নিপীড়ন করেছে। তাতে শেষ রক্ষা না হওয়ায় হাসিনা পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন আর পতন ঘটেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের।
আন্দোলন চলাকালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির ছিল। হাসিনার পতনের পর এখন পর্যন্ত পুরো মাত্রায় গতি ফেরেনি। বরং শিল্পকারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর জনরোষ ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হামলায় অনেকগুলো কলকারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
এমতাবস্থায় বাইরের তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চলমান প্রবণতার দিকে আগে আলোকপাত করা যাক। তিন মাস আগে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড) যে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তাতে বিশ্ব বাণিজ্যের ইতিবাচক প্রবণতার উল্লেখ করে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিশ্ব বাণিজ্য অন্তত ২ শতাংশ হারে বাড়বে। ফলে গত বছরের শেষার্ধের তুলনায় এ সময়কালে পণ্য বাণিজ্যে ২৫ হাজার কোটি ডলার ও সেবা বাণিজ্যে ১০ হাজার কোটি ডলার যুক্ত হবে। সর্বোপরি প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক প্রবণতা বজায় থাকলে ২০২৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
এই পূর্বাভাসের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। চলতি বছরের তিনটি প্রান্তিকও শেষ হয়েছে; যদিও এ সময়কার বিশ্ব বাণিজ্যের তথ্য এখনো মেলেনি। এটা পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লউটিও) গত মাসের প্রথম সপ্তাহে যে পণ্য বাণিজ্যের ব্যারোমিটার প্রকাশ করেছে, তাতে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এসে বৈশ্বিক পণ্য রপ্তানি বাড়ার আভাস মিলেছে। সর্বোপরি গত সপ্তাহে ডব্লিউটিও যে হালনাগাদকৃত গ্লোবাল ট্রেড আউটলুক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস প্রকাশ করেছে, তাতে চলতি বছর বিশ্ব বাণিজ্য ২ দশমিক ৭০ শতাংশ হারে বাড়বে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এসব পূর্বাভাস বিবেচনায় চলতি বছরের শেষার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) অথবা বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি কিছুটা গতি পাবে বলে আশা করা যায়।
কিন্তু ডব্লিউটিও চারটি বড় ধরনের ঝুঁকির কথাও উচ্চারণ করেছে। এগুলো হলো ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, চলমান বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত, উন্নত বিশ্বে মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন এবং শ্লথ রপ্তানি আদেশ। এসবই বাংলাদেশের রপ্তানির সম্ভাবনায় কালো ছায়া ফেলতে পারে এ বছরই।
আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলার পাশাপাশি হামাসকে নির্মূল করার জন্য এক বছর ধরে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ধ্বংস হয়ে গেছে গাজার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৭০ শতাংশ ভৌত অবকাঠামো। আর ইসরায়েল এখন হিজবুল্লাহকে নির্মূল করার জন্য লেবাননে ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর ইরান ইসরায়েলে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পর। এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর না মিললেও ইসরায়েল প্রতিশোধ নিতে ইরানে যেকোনো সময়ে হামলা চালাবে, তা নিশ্চিত। ফলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য এক বড় ধরনের যুদ্ধের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে, যা আরও বাড়বে। পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ কার্যক্রমে ব্যয়ও বেড়েছে বিমা ও জাহাজিকরণ খরচ বেড়ে গিয়ে। এগুলো আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যদি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে এক মাসের কম সময়ের মধ্যে। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হন, তাহলে তা বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক সংঘাত ও যুদ্ধকে আরও প্রলম্বিত করবে। পাশাপাশি ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দেবে, যা বিশ্ব বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আবার ডব্লিউটিওর হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ–ও বলা হয়েছে যে চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বিশ্ব পণ্য বাণিজ্য ২ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে বেড়েছে। তবে এ সময়কালে ইউরোপে পণ্যের চাহিদা প্রত্যাশার চেয়ে কম ছিল, যদিও এশিয়ায় তা বেশ চাঙা ছিল। বছরের শেষার্ধে ইউরোপে চাহিদা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে আশা করা হয়েছে এতে। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ইউরোপ যায়। সেখানে চাহিদা না বাড়লে তা পণ্য রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে উত্তর আমেরিকায় পণ্য আমদানি মোটামুটি বাড়বে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য কিছুটা আশার সংবাদ।
সব মিলিয়ে সম্ভাবনার বিপরীতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার পাল্লাটা যখন ভারী, তখন চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। আর অর্থবছর শেষে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা আরও কম, অন্তত বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির ঝুঁকিগুলো বিবেচনায়।
আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক। asjadulk@gmail.com