তালেবান শাসকদের হাত থেকে বাঁচতে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য আফগান নাগরিকদের মরিয়া হয়ে উঁচু বেড়া টপকে কাবুল বিমানবন্দরে ঢোকার ছবিগুলো আমাদের ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে হৃদয়বিদারক রেকর্ড হয়ে থাকবে।
পশ্চিমারা তাদের আফগান মিত্রদের যেভাবে ভাগ্যের হাতে ফেলে দিয়ে চলে এসেছে, তা বাইডেন প্রশাসনের পুরোনো প্রতিশ্রুতিকে ঝেড়ে ফেলে নতুন কৌশল আলিঙ্গনের নীতিরই প্রতিচ্ছবি।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সমালোচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে আফগান নারী ও মেয়েদের অধিকারের বিষয়টিকে যথাযথভাবে আমল না দেওয়া এবং মার্কিন গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও পরিকল্পনার অভাব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অজস্র সমালোচনা করা যায়। এসব সমালোচনার মূল কারণ হলো একটি অপস্রিয়মাণ দশকের ফেলে যাওয়া যন্ত্রণার দুঃসহ স্মৃতি। এসব স্মৃতি কয়েক প্রজন্ম আফগানদের তাড়া করে ফিরবে।
অনেক দেশ আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার কাজ করতে প্রতিশ্রুতি দিলেও এ বিষয়ে তারা তাদের নাগরিকদের সম্মতি পেতে বেগ পাবে। কারণ, যে সর্বজনীন মূল্যবোধ ও উদার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন চায়, আফগানিস্তানের পটভূমিতে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেছে।
২০ বছর আগে আফগানিস্তানে চালানো মার্কিন নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপ ছিল উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকাতেও আইনের শাসনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আনার চেষ্টার সর্বশেষ সামরিক নিদর্শন।
পশ্চিমে যঁারা বাইডেনের নীতিকে আক্রমণ করে থাকেন, তাঁরাই মূলত এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তনে বিরক্ত। বাইডেনের এই সিদ্ধান্তকে বুঝতে হলে আমাদের এই নতুন জমানার মূল সুরকে আত্মস্থ করতে হবে। আফগানিস্তানে পশ্চিমা মিশন শুরুর সময়ে যে বিশ্বায়িত শক্তি আমাদের একত্র করেছিল, এখন তারাই আমাদের আলাদা করে দিচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল, ব্যাপকভাবে মানুষের এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাওয়া এবং তাৎক্ষণিকভাবে তথ্যপ্রবাহ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। এর সব কটিই বঞ্চনার বোধ ও ঈর্ষার মহামারিকে উসকে দিচ্ছে। কারণ, সবখানেই লোকজন নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে সুবিধা পাওয়া লোকদের সঙ্গে তুলনা করছে। এই বঞ্চনার অভিযোগ আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন একটি ধারার রাজনীতি নিয়ে এসেছে, যার প্রচলন করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের সেই ধারাকেই বিশ্বের অনেক নেতা গ্রহণ করেছেন।
এখন এই ধারাকে বজায় রেখে যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আগে আমেরিকার স্বার্থ’ উন্মাদনা এবং বিদেশের মাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ প্রত্যাহার সমর্থন করা অভিজাতদের প্রতি ব্যাপক জন-অনাস্থার মিশেল দিয়ে চলতে হচ্ছে। এ কারণে আফগানিস্তানে ‘অনন্তকালীন যুদ্ধ’ শেষ হওয়ার পরও সেখানে শান্তি আসবে না। সেখান থেকে মার্কিন উপস্থিতি সরিয়ে আনা হলেও সেখানকার ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র একেবারে ছেড়ে দেয়নি।
তালেবান তাদের অভ্যন্তরীণ শত্রুদের যুদ্ধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করতে রাজি করাতে তথ্যপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আফগানিস্তান থেকে তালেবানের ভয়ে বেরিয়ে যাওয়া অভিবাসীদের বেলারুশসহ কিছু দেশ নিশানা করেছে, যারা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপক্ষে রয়েছে। এসব দেশ বিভিন্নভাবে আফগানদের মধ্যে তালেবান শাসন সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে।
একই সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা লোকদের তাদের সীমান্ত ব্যবহার করে ইউরোপে যেতে উৎসাহিত করছে। ভবিষ্যতেও তারা এটি করতে থাকবে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সহায়তা প্রবাহ বাড়িয়ে সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে। এটি যুদ্ধ নয়, কিন্তু এটি শান্তিকেও ত্বরান্বিত করবে না। বিশেষ করে যেখানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে, সেখানে আফগানিস্তানে নিরঙ্কুশ শান্তির সম্ভাবনা কম।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মাথায় রেখে বাইডেনের পরবর্তী কাজ হলো একটি জোট গড়ে তোলা, যেটি ভবিষ্যতের অশান্তি সামাল দিতে পারবে। তিনি এ বিষয়ে কাজ শুরু করলেও তা জোরালো নয়।
অনেক দেশ আফগানিস্তান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবার কাজ করতে প্রতিশ্রুতি দিলেও এ বিষয়ে তারা তাদের নাগরিকদের সম্মতি পেতে বেগ পাবে। কারণ, যে সর্বজনীন মূল্যবোধ ও উদার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন চায়, আফগানিস্তানের পটভূমিতে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে গেছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন অগ্রাধিকার থেকে দ্রুত সরে যাওয়ায় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং আমেরিকার স্থানীয় মিত্রদের যে বিপদে পড়তে হয়েছে, তার ছবি সহজে মুছে ফেলবে না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত
মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক