দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা, আমাদের কেন হয় না

আমাদের উচ্চশিক্ষালয়গুলো এখনো কোভিডকালীন ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। কোভিডে পাবলিক পরীক্ষাগুলো এখন লাইনচ্যুত। যার কারণে পিছিয়ে গেছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আর তার ধাক্কা লেগেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায়। এসব মাথায় নিয়ে শেষ হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঠিক কোন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে, তার কাঠামো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষার। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় নেওয়া হবে এই ভর্তি পরীক্ষা?

কেন ‘একক ভর্তি পরীক্ষা’

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এক দশক ধরে দেশে আলোচনা চলছে। ভর্তি পরীক্ষার সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ছোটাছুটি করতে হয়। এতে যেমন শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক শক্তি ক্ষয় হয়, তেমনি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হোন। এসব ভোগান্তি নিরসনে ২০১৮ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে। তবে শীর্ষ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়ায় অংশ না নেওয়ায় গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার সুফল কিছুটা বিঘ্নিত হয়ে আসছিল, যা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রথম আলোয় বেশ কিছু লেখা লিখেছি।

তবে গত ১৫ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের নির্দেশে প্রজ্ঞাপন জারি করে চলতি ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একক ভর্তি পরীক্ষার আওতায় নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দায়িত্ব প্রদান করে। এর পর বিভিন্ন দফায় ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠক করে মোটামুটিভাবে একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।

চলতি মাসের ১১ তারিখে ইউজিসি একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের জন্য অধ্যাদেশ জারির জন্য সুপারিশ করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, গত জুলাই মাসে একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে ইউজিসি চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি (এনটিএ) গঠনের আগপর্যন্ত এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আইনে যা-ই থাকুক না কেন, এই অধ্যাদেশ প্রাধান্য পাবে। এ ছাড়া কমিশনের একজন সদস্যের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটিকে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অর্থাৎ ইউজিসির উদ্যোগ ও আন্তরিকতার কমতি না থাকলেও একক ভর্তি পরীক্ষা ঠিক কোন কাঠামোয় হবে, তার সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাইনি। একক ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরার আগে চলুন দেখে আসি, বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা এগিয়ে নিচ্ছে

দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা

দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির জন্য ১৯৭৭ সালে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ইউনিভার্সিটি এনট্রান্স নামে একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়। এর দুই বছর পর ১৯৭৯ সালে একটি ‘সাধারণ ভর্তি’ পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শুরু করে দেশটি। নব্বইয়ের দিকে ন্যাশনাল সেন্টার টেস্ট (এনসিটি) গঠন করে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই ভর্তি পরীক্ষার কাতারে আনা হয়। জাতীয় ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরে ভর্তি-ইচ্ছুক প্রার্থীদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে আবার ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে, তাঁর বিভাগ নির্ধারিত হয়।

চীনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নেয়, ‘গাওকাও’ যার পূর্ণাঙ্গ নাম ‘ন্যাশনালওয়েড ইউনিফাইড এক্সামিনেশন ফর আডমিশন টু জেনারেল ইউনিভার্সিটি’। যেখানে শুরুতে সব শিক্ষার্থীকে চায়নিজ বা অন্যান্য ভাষার দক্ষতা এবং গণিত বিষয়ে বাধ্যতামূলক পরীক্ষা দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে কলা ও বিজ্ঞান শাখায় বিভক্ত হয়। কলাবিষয়ক অধ্যয়নে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ভূগোল জ্ঞান যাচাইয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয় আর বিজ্ঞানে জীব, পদার্থ আর রসায়নে পরীক্ষায় বসতে হয়।

দক্ষিণ কোরিয়ায় চালু রয়েছে কলেজ স্কলাস্টিক অ্যাবিলিটি টেস্ট, যাকে কোরিয়ান ভাষায় সুনেয়াং বলে। ১৯৯৪ সাল থেকে চালু এই পদ্ধতিতে ছয়টি সেকশনে যেমন কোরিয়ান নিজস্ব ভাষা, ইংরেজি, কোরিয়ান ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা বিজ্ঞান, গণিত এবং বিদেশি ভাষায় দক্ষতা যাচাইয়ে পরীক্ষা নেওয়া। গণিতের পরীক্ষায় দুই ভাগে বিভক্ত থাকে, যেখানে একটি গ্রুপ যারা বিজ্ঞান বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চায়, তাদের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয় আর একটি ভাগে যারা কলাবিষয়ক বিভাগে পড়াশোনা করতে চায়। অন্যদিকে সমাজবিদ্যা এবং বিজ্ঞান সেকশনে আলাদা আলাদা বিষয় থাকে যেমন রসায়ন, পদার্থ, জীববিদ্যা। আর সমাজবিদ্যায় নৈতিক শিক্ষা, ভূগোল, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা কারিগরি শিক্ষা।

ইউনিফাইড স্টেট এক্সাম বা ইজিই মাধ্যমে রাশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে। গণিত ও রাশিয়ান ভাষা বাধ্যতামূলক করে পদার্থ, রসায়ন, বায়োলজি, ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, সাহিত্য ও বিদেশি ভাষার দক্ষতার ওপর প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়, যার মধ্য থেকে অন্তত দুটি বিষয়ে উত্তর দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরে অ্যাসাইনকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি-ইচ্ছুকদের মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করে।

ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য ২০০২ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্র্রান্স এক্সামিনেশন’ বা আইইইই নামে পরীক্ষা চালু হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের দিকে ‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সাম’ বা জেইই নামকরণ করা হয়, যা বর্তমানে কম্পিউটার বেইজড পরীক্ষার আয়োজন করে। ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যতীত ভারতে ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট’ বা এনইইটি (নিট) নামে পরীক্ষা চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে ভারতে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়।

এ ছাড়া ‘কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট’ বা চুয়েট এর অধীনে দেশটির কেন্দ্রীয় ৪৩টি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়,  ১২টি ডিমড, ১৩টি প্রাদেশিক এবং ১৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রদেশ যেমন পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সাম মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করানো হয়।

কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট সাধারণত একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি থেকে তিনটি সেকশনে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রথম সেকশনে ক শাখায় সেই দেশের বিভিন্ন ভাষার ওপর প্রশ্ন থাকে আর খ শাখায় বিদেশি ভাষার দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য ৫০টি এমসিকিউ প্রশ্ন থাকে, যার সময় করা হয়। দ্বিতীয় সেকশনে মূলত বিষয়ভিত্তিক যেমন অর্থনীতি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সংস্কৃত, পদার্থ, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, প্রাণরসায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন থাকে, যার মধ্য থেকে ৬টি বিষয়ে ৫০টি এমসিকিউ প্রশ্ন থাকে, যা ৪৫ মিনিটে উত্তর দিতে হয়। আর তৃতীয় সেকশনে রয়েছে সাধারণ জ্ঞান, যেখানে এক ঘণ্টায় ৭৫টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।

এসব ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি বা এনটিএ। ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই প্রতিষ্ঠান মূলত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, বণ্টন, ফলাফল ঘোষণার দায়িত্বে থাকে। পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মেধাক্রম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশিত হয়, যা পরবর্তী সময়ে ভর্তিপ্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হয়।

আমরা যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একক ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারি

ইউজিসি ইতিমধ্যে ভারতের আদলে ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি বা এনটিএ গঠনের সুপারিশ করেছে। আমরা যদি ধরেই নিই, এই সংস্থার অধীনে দেশের অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হচ্ছে, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তবে আমার মতামত থাকবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষাও ঠিক একই কাঠামোতে আসা উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরে একবার স্নাতকে ভর্তির আয়োজন করলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত আর্থিক বা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভর্তি করিয়ে আসছে, যা সামঞ্জস্যহীন।

এনটিএ যেমন হবে

আমরা যদি ধরেই নিই জাতীয় ভর্তি পরিচালনা পরিষদ বা এনটিএ গঠন করা হয়, তবে এই প্রতিষ্ঠান কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, তার সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি। দেশে সরকারি কর্ম কমিশন বা পিএসসি যেভাবে বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণ করে আসছে, ঠিক এই নির্ভরতার জায়গা থেকে এনটিএ গঠন অমূলক হবে না। তবে সেই সংস্থার কাঠামোতে আমলাতান্ত্রিক কোনো পদপদবি না থাকা বাঞ্ছনীয়। অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির শিকলে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অভিজ্ঞ শিক্ষক ও গবেষণায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিয়ে এই কমিটি থাকবে। আচার্যকে পদাধিকার প্রধান করে ১০-১৫ সদস্যের কমিটি থাকবে, যেখানে ৫ জন দেশবরেণ্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাবিদ (অধ্যাপক পদমর্যাদার), ৩ জন দক্ষ প্রকৌশলী, যাঁদের দক্ষতা থাকবে সফটওয়্যার, এআই ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষক, ২ জন মনস্তত্ত্ববিদ, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পদমর্যাদার লেখক ৩ জন, ১ জন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এবং ১ জন ইউজিসির সদস্য। এর বাইরে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণে এই মূল কমিটি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে পারে।

সমন্বিত এই কমিটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা থাকবে না। এমনকি সরাসরি রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন করেন এমন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া যাবে না, যাঁরা ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারেন কিংবা প্রভাবিত হতে পারেন।

  • ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com