কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দেশের প্রথম সুড়ঙ্গসড়ক।
কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দেশের প্রথম সুড়ঙ্গসড়ক।

মতামত

চট্টগ্রাম ২০২৩: এই সব ডামাডোল ও ঘটনা নিয়েই বিদায় নিল বছর

২০২৩ সাল ডামাডোলের বছর। নির্বাচনের হইচইয়ের মধ্যে বছরটা শেষ হয়েছে। একাদশ সংসদের অন্তিম বছরের শুরু থেকেই একধরনের উত্তাপ রাজনৈতিক অঙ্গনকে সরগরম করে রেখেছিল।

একটা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি সারা বছর সোচ্চার ছিল। নানা কর্মসূচিতে মাঠে সরব ছিল এই দল। পাশাপাশি সরকারি দল আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে রেখেছিল পুরোটা সময়।

শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটি নিয়ে পুরো জাতির মধ্যে একটা উত্তেজনা ছিল, তা থেকে বাদ যায়নি চট্টগ্রামও; বরং ঢাকা ছাড়া দেশের অন্য সব জায়গা থেকে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি কার্যালয় নাসিমন ভবনকে ঘিরে উত্তেজনা প্রায় সারা বছরই ছিল। নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে, কেমন হবে তা নিয়ে ভাবনা, গুঞ্জন রটনা, ঘটনা নিয়েই একটি বছর আমাদের কাল থেকে বিদায় নিল।

আবার রাজনৈতিক এই উত্তাপের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ডেঙ্গুকাহিনি। করোনার ভয়াবহ কালকে উত্তরণের পর এখন ডেঙ্গুই সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৪ হাজার মানুষ, আর প্রাণ হারিয়েছেন ১০৭ জন। এই রোগের দুর্ভোগ আর ওই মৃত্যুকে নিয়তি হিসেবে মেনে আমাদের খুব কষ্ট হয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের যা যা করার ছিল, তা করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যে ব্যর্থ হয়েছে, তা শতাধিক মৃত্যু আর আক্রান্তের পরিসংখ্যানই আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক উত্তাপ ও ডেঙ্গুর দাপটে মানুষের দুর্ভোগের সঙ্গী ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের চড়া দাম মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। চাল, ডিম, চিনি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, আলু, এলাচসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়তি থাকায় বছরের প্রায় সব কটা মাস একটি উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে।

বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রতিদিন ঢাকা থেকে কক্সবাজার যায়। এই ট্রেন ভোর চারটার দিকে চট্টগ্রামে যাত্রাবিরতি করে। ট্রেন ধরার জন্য ওই সময়টা চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে অনুকূল নয়। সে কারণে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত হলেও চট্টগ্রামবাসী সরাসরি এর সুফল এখনো পাচ্ছেন না।

এই উৎকণ্ঠার ভেতরেও কারও জীবন থেমে থাকেনি। সারা দেশের মধ্যে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে, বিশেষ করে যোগাযোগব্যবস্থায় যেসব মাইলফলক তৈরি হয়েছে, চট্টগ্রামও তার অংশীদার হতে পেরেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষী হলো চট্টগ্রাম।

কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ এর মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই সুড়ঙ্গপথের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুই পাড়ে এক নতুন সংযোগ স্থাপিত হলো। আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে উন্নয়নের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ। উদ্বোধনের দুই মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও এ নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর উৎসাহ–উদ্দীপনার শেষ নেই। প্রতিদিন শত শত মানুষ টানেল দেখতে দুই পারে ভিড় করেন মানুষ।

২০২৩ সালে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষেরও আরেকটি বিশাল প্রাপ্তি ঘটেছে। এই বছর চট্টগ্রামের মানুষের শত বছরের একটি স্বপ্ন পূরণ হলো। অবসান ঘটেছে বহু যুগের অপেক্ষার। আমাদের রেলপথ শেষ পর্যন্ত কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছাল। শুধু চট্টগ্রাম নয়, এটি সারা দেশের জন্য একটি বিশাল সুখবর। কক্সবাজার পর্যটনশিল্পের বিকাশে এই রেলপথ একটি বড় ভূমিকা রাখবে বলে সবাই আশাবাদী। গত ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নতুন রেলপথ এবং কক্সবাজার রেলস্টেশন উদ্বোধন করেন।

বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রতিদিন ঢাকা থেকে কক্সবাজার যায়। এই ট্রেন ভোর চারটার দিকে চট্টগ্রামে যাত্রাবিরতি করে। ট্রেন ধরার জন্য ওই সময়টা চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে অনুকূল নয়। সে কারণে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত হলেও চট্টগ্রামবাসী সরাসরি এর সুফল এখনো পাচ্ছেন না।

চট্টগ্রামবাসীর দাবি খুব শিগগির চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী নতুন একটি ট্রেন চালু হবে। এই নতুন ট্রেনের সুখবরের সঙ্গে একটা দুঃখের বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। চট্টগ্রামবাসীর অনেক আনন্দের পাশে একটি ক্ষতের মতো রয়েছে সেই কষ্ট।

কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে শতাব্দীপ্রাচীন কালুরঘাট সেতুকে সংস্কার করা হয়েছে। আগস্ট মাসের ১ তারিখ থেকে এই সংস্কার কাজ শুরু হয়। কাজের জন্য সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিকল্প হিসেবে চালু হয় ফেরি। সেতু সংস্কার করা হলো। সেই সেতু দিয়ে পর্যটকবাহী দীর্ঘ ট্রেন চলে যায় কক্সবাজারে। তবে আর যানবাহন চালু হলো না। হাজারো মানুষ আর শত শত গাড়ির ভিড়ে দিনরাত যে কালুরঘাট কোলাহলমুখর ছিল, সেই কালুরঘাট এখন নীরব–নিস্তব্ধ। নদী পারাপারের ফেরিতে নানা অনিয়ম। বোয়ালখালীগামী গাড়িগুলো শাহ আমানত সেতু দিয়ে অনেক দূরপথ পাড়ি দিতে হয়। বোয়ালখালীবাসীর স্বপ্ন ২০২৩ সালেও পূরণ হলো না।

কালুরঘাট সেতুর দুঃখ বাদ দিয়ে চট্টগ্রামের জন্য আরও বেশ কিছু সুখবর নিয়ে এসেছিল বিদায়ী বছর। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ৫ নভেম্বর উদ্বোধন করা হলো ১০০ শয্যার ক্যানসার হাসপাতাল। নগরের আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল ক্যাম্পাসে এই হাসপাতাল উদ্বোধন করেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূল্যায়ন সূচকে স্বাস্থ্যসেবার দেশসেরায় অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে ২০২৩ সালে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বন্দরের মূল অংশ থেকে ভাটির দিকে কর্ণফুলীর মোহনায় ড্রাই ডক ও বোট ক্লাবের মাঝখানে ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৬ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ’২৩ সালেই উৎপাদনে গেল কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে স্থাপিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। একই জায়গায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনালের কাজও শুরু হয়।

চট্টগ্রাম ওয়াসা ২০২৩ সালে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মহানগরকে পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ শুরু করেছে। প্রথম ভাগে যে ২০ হাজার মানুষকে এই সিস্টেমের আওতায় আনা হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প ক্রমে বিলম্ব হওয়ার যে দুর্নাম চট্টগ্রামের কপালে লেখা আছে, এই প্রকল্পে যেন সেটি না হয়, সেই প্রত্যাশা করছেন চট্টগ্রামবাসী।

২০২৩ সালে কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। কাজীর দেউড়ির এম এ আজিজ স্টেডিয়াম–সংলগ্ন আউটার স্টেডিয়ামকে দখলমুক্ত করে এটিকে খেলার উপযোগী করে তুলছে প্রশাসন। এখানে সারা বছর যে বিভিন্ন মেলা হতো, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের ব্রিটিশ আমলের ভবনটি আড়াল করে দেওয়া অবৈধ শিশুপার্কটি উচ্ছেদ করা হয়েছে।

এখন সার্কিট হাউসের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে বিশাল মাঠ। আশপাশে গত কয়েক বছরে গড়ে ওঠা ব্যাঙের ছাতার মতো দোকানপাটের ভিড়ে এই খোলা জায়গাটুকু চট্টগ্রামবাসীর জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে এবং পরিবেশ রক্ষায় জেলা প্রশাসনের এমন উদ্যোগ নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে সবার বিশ্বাস।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক