পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম কি গণহত্যায় ইসরায়েলকে সুযোগ করে দিচ্ছে

‘অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু ও অক্ষমেরা যখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছেন, তখনো তাঁদের ওপর আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছে।’
ছবি: এএফপি

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ভূখণ্ড ও চারদিক থেকে ঘিরে রাখা ‘উন্মুক্ত জেলখানা’ গাজার ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু ও অক্ষমেরা যখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছেন, তখনো তাঁদের ওপর আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে বোমা বর্ষণ করে মারা হচ্ছে।

হামাসের হামলায় ১ হাজার ৩০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল এই নজিরবিহীন হামলা চালাচ্ছে। পশ্চিমের নেতারা সমানে ইহুদিদের আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে তাঁরা ইসরায়েলের সমালোচনা করে ইহুদিদের আহত না করার জন্য সবাইকে আহ্বানও জানিয়েছেন।

ফ্রান্স ও জার্মানি গাজাবাসীর প্রতি সমর্থন জানানো যেকোনো ধরনের র‍্যালি বা সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাজ্যও একই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।

ইউরোপের এই সব নেতাদের কেউ একবারও বলছেন না, ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময়ে যেভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করেছিল, তার চেয়ে বহুগুণ নৃশংসতায় এবার তারা বন্দুকের মুখে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করছে। তাদের জাতিগতভাবে গাজা থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে। এই নিয়ে পশ্চিমা নেতারা কোনো কথাই বলছেন না।

গাজার সঙ্গে লাগোয়া সিনাই মরুভূমির দখলচিত্র বদলে ফেলার জন্য মিসরকে চাপ দিতে অনেক বছর ধরে ইসরায়েলি নেতারা গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরিকল্পনা করছেন। ইসরায়েল চায়, গাজার সঙ্গে মিসরের ছোট্ট সীমান্ত এলাকা দিয়ে গাজাবাসীকে সিনাইয়ে তাড়িয়ে দিতে। গাজার সঙ্গে লাগোয়া সীমান্ত মিসরের আটকে দেওয়ার এটি অন্যতম কারণ। এখন ইসরায়েল সেই তোড়জোড় শুরু করেছে। তারা মরুভূমির মতো হত্যাপুরীতে তাদের পাঠিয়ে প্রকারান্তরে হত্যা করতে চায়।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো ইসরায়েলকে সেই কাজ করার সবুজ সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বিরোধীদলীয় নেতা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার বলেছেন, গাজাকে ‘সম্পূর্ণ ঘেরাও করে’ ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ আছে। বিদ্যুৎ, খাবার, পানির অভাবে মরণাপন্ন মানুষের কষ্টের কথা উড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নরপশু’ বলে উল্লেখ করেছেন। স্টারমার প্রকৃত পক্ষে ইসরায়েলের গণহত্যাকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আইন উপদেষ্টা ক্লিভ ব্যাল্ডউইন বলেছেন, ইসরায়েল এমন এক অবস্থার মধ্যে গাজা থেকে মানুষগুলোকে বাস্তুচ্যুত করছে, যখন অসহায় লোকগুলোর পালানোর পথও এবড়োখেবড়ো, জ্বালানি নেই এবং হাসপাতালগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, ‘অনেক দেরি হেয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্বনেতাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।’

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্বনেতাদের বড় অংশই ‘মুখ খোলার বিষয়ে’ কোনো ধরনের চাপের মুখে নেই। কারণ, মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের কোনো বক্তব্যকে সমালোচনার দৃষ্টি দিয়ে দেখছে না। আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরায়েলের চালানো তৎপরতাকে তারা স্থূলভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

চ্যানেল ফোর টিভির সাংবাদিক যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিনকে হামাসের ‘নিন্দা’ জানাতে বলেছিলেন। ওই সময় তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদেরও মানবাধিকার নিশ্চিত করা উচিত বলে মন্তব্য করার পর সাংবাদিক ভদ্রলোক তাঁকে ‘ইহুদিবিরোধী’ কোনো মন্তব্য না করার জন্য সতর্ক করে দেন।

মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছিল, হামাস ৪০ জন ইসরায়েলি শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছে। এত বড় অভিযোগ করার পর তারা অভিযোগের সমর্থনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ সামনে আনতে পারেনি। গাজার যেখানে ওই শিশুদের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল, সেখানে পরে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরা গিয়ে বলেছেন, সে ধরনের কোনো আলামত তাঁরা দেখতে পাননি।

এই অভিযোগটি মূলত এসেছিল ইসরায়েলি সেনাদের দিক থেকে। যখন তাঁদের তথ্য–প্রমাণ দিতে বলা হয়েছে, তখন তাঁরা চুপ করে গেছেন।

২০০৩ সালে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য যেভাবে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা গল্প ফাঁদা হয়েছিল, তার সঙ্গে হামাসের শিশু হত্যার কাল্পনিক গল্পের মিল পাওয়া যাচ্ছে।

১৯৯০ সালে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের বাহিনী কুয়েত অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র কুয়েত অভিযোগ করেছিল, ইরাকি সেনারা কুয়েতের হাসপাতালগুলোর ইনকিউবেটরে থাকা নবজাতকদের অক্সিজেন সরিয়ে তাদের হত্যা করেছে। এই অভিযোগকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করেছিল।

২০১১ সালে পশ্চিমা কর্মকর্তারা অভিযোগ তুলেছিলেন, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির অনুগত সেনারা বেনগাজিতে ভিন্নমতাবলম্বী নারীদের ওপর গণধর্ষণ চালানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত যৌন উত্তেজক ওষুধ ভায়াগ্রা সেবন করেছিলেন। সেই অভিযোগকে প্রায় সত্য ঘটনা বানিয়ে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম সমানে প্রচার চালিয়েছিল। পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি তদন্তে সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কিন্তু তত দিনে গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়ে গেছে।

একই ঘটনা গাজার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ডের খবরে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘মারা যাওয়া’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলিদের ক্ষেত্রে ‘নিহত’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা ‘প্রতিরোধ’ শব্দটিকে শুধু ইসরায়েলি সেনাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। বিবিসির একজন সাংবাদিকও নেই, যিনি ইসরায়েলি সেনাদের গণহত্যা চালানোকে ‘প্রতিরোধ’ হিসেবে বর্ণনা করতে দ্বিধা করবেন।

গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের দূত হুসাম জোমলোতের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিবিসির সাংবাদিক তাঁকে বারবার হামাসের নিন্দা জানানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ভাবটা এমন ছিল, যেন তিনি নিন্দা না জানালে তা সন্ত্রাসকে সমর্থন দেওয়ারই নামান্তর হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিবিসি ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁকে নেতানিয়াহুর নির্বিচার বোমাবর্ষণের আদেশ দেওয়ার বিষয়ে নিন্দা জানাতে বলেননি।

এভাবে প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে সাংবাদিকতার নামে অ্যাক্টিভিজম করে যাচ্ছে। এটি পরিষ্কারভাবে ইসরায়েলের বিপর্যয় সৃষ্টির পথকে সুগম করে দিচ্ছে।

  • জনাথন কুক ইসরায়েল–ফিলিস্তিনি সংঘাতবিষয়ক বিশ্লেষক ও এই বিষয়সংক্রান্ত লেখক ও গবেষক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত