বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোয় (কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর) শুঁটকিশিল্প ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে। দেশে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদিত হয় সুন্দরবনের দুবলারচর, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়ারচর, মহেশখালী ও কক্সবাজারের নাজিরারটেকে। এককভাবে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদিত হয় নাজিরারটেকে। প্রসারের পাশাপাশি এ শিল্প নানা ধরনের বিপত্তিরও জন্ম দিচ্ছে। শুঁটকিপল্লিতে শিশুশ্রমিকের অনিয়ন্ত্রিত নিয়োগ এবং তাদের নিষ্ঠুর কর্মপরিবেশের কথা আমরা জানি।
দেশি–বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় বেশ কিছু বেসরকারি সংগঠন অনেক শুঁটকিপল্লিতে শিশুশ্রম নিরসনের কাজ করে চলেছে। কিন্তু যেসব শিশুর কাজের বয়স হয়নি, তারাও মায়ের সঙ্গে শুঁটকিপল্লিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক বৈরী পরিবেশে শৈশব হারাচ্ছে। তাদের নিয়ে খুব কম কথা শোনা যায়। তারা যেন থেকেও নেই, অদৃশ্য এক জনগোষ্ঠী। নারী কর্মীদের সঙ্গে থাকা সন্তানদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও কেউ উচ্চবাচ্য করে কি?
অনির্ধারিত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয় বলে মায়েরা তাঁদের কোলের শিশুকে অন্য কারও কাছে রেখে আসতেও পারেন না। জীবিকার তাগিদে শুঁটকিখোলায় আসা অধিকাংশ নারী বিভিন্ন জেলার অভিবাসী। এ কারণে শিশুর সুরক্ষায় বর্ধিত পরিবার বা পাড়াপ্রতিবেশীর সহায়তা প্রায় নেই বললেই চলে। আবার ছোট শিশুদের প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে ন্যায্য আচরণের সক্ষম ব্যক্তি সহজে মেলে না।
কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়া এলাকায় কাজ করে—এমন সংগঠনের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে কাজ করা শুঁটকিশিল্পের শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ নারী। শুধু কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লিতেই কাজ করেন ৬ হাজার ৩০০–এর বেশি নারী। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে গড়ে দু–তিনটি শিশুসন্তান থাকে, যাদের কাজের ‘বয়স’ হয়নি, কিন্তু মায়ের সঙ্গে থাকে। এর মধ্যে দুধের শিশুও আছে।
নারীরা এখানে মূলত সাগর থেকে ধরে আনা মাছের শ্রেণিভাগ ও পরিষ্কার করে শুকাতে দেওয়ার কাজ করেন। ঘাটে ট্রলার বা নৌকা ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কাজ শুরু হয়। সেটা যেকোনো সময় হতে পারে। শুঁটকিখোলার মালিকদের মুঠোফোনের অপেক্ষায় থাকতে হয় নারীদের। সাধারণত সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে থাকেন তাঁরা। অনেক সময় গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হয়। এ সময় তাঁদের সন্তানেরা কাছে থাকলেও শিশুদের স্বাস্থ্য বা সুরক্ষার অন্যান্য বিষয়ের প্রতি তাঁদের নজর দেওয়া সম্ভব হয় না।
বেসরকারি সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্যমতে, শুধু নাজিরারটেকেই নারী শ্রমিকদের সঙ্গে ১২ হাজার ৬০০ থেকে ১৮ হাজার ৯০০টি শিশু খোলাগুলোয় অবস্থান করে। দিনের পর দিন এসব শিশু শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার অনুপস্থিতিতে নানা রকম অবহেলা, অবমাননা, অনাদর ও অনাহারে জীবন যাপন করে। শুঁটকিপল্লিগুলো ওদের মায়েদের দিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছে বটে, কিন্তু মায়ের সঙ্গে আসা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার বিষয়ে শুঁটকিপল্লির মালিকেরা একেবারেই নীরব।
পটুয়াখালী অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর সূত্রে জানা যায়, মায়েরা কাজের সময় শিশুকে পাশে রেখে কাজ করেন অথবা শুঁটকিখোলার বেড়িতে (উঁচু জায়গায়) রেখে কাজ করেন। সেটাও শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। জানা যায়, মায়েদের সঙ্গে শুঁটকিপল্লিতে আসা ছোট শিশুদের মধ্যে সাধারণত ৯০ শতাংশ রোদ প্রখর হলে মাছ শুকানোর মাচার নিচে বসে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করে। দু–একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেস্ট অ্যান্ড ব্রেস্টফিডিং সেন্টার চালু করলেও মা শ্রমিকদের বিশ্রাম, শিশুদের খেলাধুলা বা দুধ খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপদ স্থান নেই। খোলা জায়গায় অথবা মাচার নিচে বসেই মায়েরা শিশুদের দুধ পান করান এবং নিজেদের খাবার খান।
শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতের সময় লবণের ব্যবহার, রাসায়নিক উপকরণ, কীটনাশক ব্যবহার, দীর্ঘ সময় রোদে অবস্থান এবং শুঁটকির বর্জ্য ও মাছ ধোয়া পানির দুর্গন্ধ পল্লিতে অনাদরে পড়ে থাকা শিশুদের বিভিন্ন রোগে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শুঁটকিপল্লিগুলোয় পানের জন্য নিরাপদ পানির পরিমাণ খুবই সীমিত। এলাকাগুলো সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় এখানে লোনাপানির সর্বব্যাপী প্রভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না থাকায় শিশুরা নানা শারীরিক সংকটের শিকার হয়। শুঁটকিপল্লির শিশুদের ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের সংক্রমণসহ প্রভৃতি রোগে বারবার আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা থেকে বাস্তুচু্যত হয়ে নারীরা শুঁটকিখোলায় আসেন। বেশির ভাগ শুঁটকিপল্লি অস্থায়ী ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠায় এখানে শিশুদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠ গড়ে ওঠেনি। মায়ের সঙ্গে চরম প্রতিকূল পরিবেশে নিরুপায় দিনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব শিশুকে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি নানা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়ে। অনেক শিশু কম বয়সেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখ ফোলা, পিঠব্যথা এবং দীর্ঘ সময় রোদে পড়ে থাকায় ‘ত্বক কালচে হয়ে যাওয়া’ (ওভার বার্ন) সমস্যায় ভোগে। বলা বাহুল্য, প্রান্তিক এসব এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসুবিধাও সহজপ্রাপ্য নয়। শুঁটকিপল্লিগুলোয় কাজ করতে আসা একা অভিবাসী পুরুষ শ্রমিকদের মধ্যে একাধিক বিয়ের প্রবণতা আছে। মা–বাবা মেয়েশিশুদের ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে তাদের বিয়ে দিতে উৎসাহিত হন। এ কারণে কম বয়সে সন্তান ধারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
শুঁটকিপল্লির শিশুদের অনুপযুক্ত বৈরী পরিবেশ রাতারাতি অবসান করা হয়তো সম্ভব নয়। তবে শিশুসহনীয় একটা পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলা যেতেই পারে। তার আগে এই ‘অদৃশ্য’ শিশুদের দৃশ্যমান করা প্রয়োজন; প্রয়োজন হালনাগাদ তথ্যের। মায়ের সঙ্গে আসা শিশুদের জন্য নিরাপদ একটা চালের (ছাদের) নিচে নির্বিঘ্নে বিশ্রাম আর শৈশবকালীন কর্মকাণ্ড চালানোর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। এগুলো পরিচালিত হবে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিশুবান্ধব ব্যক্তিদের মাধ্যমে। শিশুর নিরাপত্তা, বিশ্রাম, খাবার, শৌচাগার—এসব নিয়ে মা যত কম পেরেশানির মধ্যে থাকবেন, তিনি তত কাজে মন দিতে পারবেন; বাড়বে তাঁর ঘণ্টাপ্রতি উৎপাদনক্ষমতা। মুনাফামুখী মালিকদের সে সত্য বুঝতে হবে।
শুঁটকিপল্লিতে কাজ করতে আসা মানুষদের ‘বস্তি’ এলাকায় প্রাক্–প্রাথমিকসহ প্রাথমিক স্কুলের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এর জন্য বড় দালানকোঠা না বানালেও চলবে। অস্থায়ী এসব স্কুল কাছের বড় স্কুলের ফিডার স্কুল হিসেবে কাজ করতে পারে।
এসব কাজ মৎস্য ও প্রাণিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। এটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক wahragawher@gmail.com