একাত্তরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তি লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ছিল শূন্যের কোঠায়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ছিল মূলত বৈদেশিক অনুদাননির্ভর। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে ৭৮ শতাংশ বাংলাদেশি চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত।
সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশ আজ স্বনির্ভরতার অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত। এর পেছনে রয়েছে নিবেদিতপ্রাণ কিছু মানুষের অসামান্য অবদান। তাঁদের একজন ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে স্যার ফজলে হাসান আবেদ এ সংস্থায় প্রতিশ্রুতিশীল একদল বাংলাদেশি তরুণকে একত্র করেন। আবেদ ভাই এবং তাঁর সেই কর্মী বাহিনীর উদ্যোগগুলো দ্রুততর সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন–অগ্রযাত্রায় একীভূত হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশ ও ব্র্যাক তাই একই সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে। জন্মগ্রহণ থেকে আজ পর্যন্ত উভয়ই একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মানুষের দুরবস্থা লাঘবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়। ব্র্যাকের কার্যক্রমের সূচনাও ছিল প্রায় একই রকম। ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম শাল্লায় অক্সফামের সহযোগিতায় ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে সংস্থাটি যাত্রা শুরু করে।
অতি দ্রুতই অবশ্য সংশ্লিষ্ট সবাই ত্রাণভিত্তিক সহায়তা থেকে আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন। আবেদ ভাই দ্রুত উপলব্ধি করেন, স্বল্পমেয়াদি এ সহায়তা যথেষ্ট নয়। দরিদ্র মানুষের জন্য আয়ের উৎস তৈরি করতে হবে। তাদের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সম্পদের চাহিদাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ উপলব্ধি থেকে ব্র্যাক একে একে শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, দরিদ্র মানুষের সংগঠন গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রের কাছে সেবা দাবি করার জন্য তাদের ক্ষমতায়নের কার্যক্রম গ্রহণ শুরু করে।
প্রায় একই সময়ে সরকারিভাবে অতিদরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমের চিন্তা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে দুটি কর্মসূচির কথা বিশেষভাবে বলা যায়। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে নারীপ্রধান পরিবারকে কেন্দ্র করে ‘ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং’ (ভিজিএফ) কর্মসূচি শুরু হয়। ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ নামে অন্য কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল বন্যায় জীবিকা হারানো গ্রামীণ কৃষকদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া।
দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমকে গতিশীল করতে যদিও শুরু থেকেই ব্র্যাক ক্ষুদ্রঋণ চালু করেছিল, আশির দশকে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করে, যা পরবর্তীকালে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এ সময়ে ব্র্যাক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সঙ্গে অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করে এবং উন্নয়ন–অগ্রগতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে কর্মসূচিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনয়নের কাজও চালিয়ে যায়। ফলে সেগুলো আরও কার্যকর এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত হতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা দিতে বীজ উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের উন্নত বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্র্যাক।
নব্বইয়ের দশকে শুরুতে শুধু খাদ্যনিরাপত্তা নয়, বরং সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন চিন্তা শুরু হয়। ১৯৮২ সালে সরকার ভিজিএফ কর্মসূচিকে নতুনভাবে ‘ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট’ (ভিজিডি) নামে চালু করে। এর লক্ষ্য ছিল সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের পরিধিকে বিস্তৃত করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করা।
এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্র্যাক ভিজিডি কর্মসূচিতে খাদ্যসহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদি কার্যক্রমকে সমন্বয়ের সম্ভাবনা যাচাই করতে সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কাছে একটি পাইলট প্রকল্প পরিচালনার প্রস্তাব দেয়। পাইলট প্রকল্পটি মানিকগঞ্জে পরিচালিত হয়।
এ প্রকল্পে ব্র্যাক দরিদ্র নারীদের জন্য উপযুক্ত জীবিকা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। পাশাপাশি সঞ্চয় বৃদ্ধি, শিশুপুষ্টি, শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যয় নিশ্চিত করাসহ অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর সামগ্রিক উন্নয়নে এ প্রকল্প বহুমুখী প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। এই সাফল্যে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও ব্র্যাক সমন্বিতভাবে ভিজিডি কর্মসূচির একটি নতুন দিক ‘ইনকাম জেনারেটিং ফর ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট’ (আইজিভিজিডি) কর্মসূচি শুরু করে। এই কর্মসূচি ‘সামাজিক সুরক্ষাসংবলিত সমৃদ্ধি’-র একটি চমৎকার উদাহরণ, যা এতে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীকে দারিদ্র্যের কবল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকের বেশির ভাগ সময়জুড়ে আইজিভিজিডি কর্মসূচি যখন সব মহলে প্রশংসিত, তখনই ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় ধরা পড়ে একটি অপ্রিয় সত্য। সেটি হলো সমাজের অতিদরিদ্র পরিবারগুলো আইজিভিজিডির সুবিধা পাচ্ছে না। মূলধারার উন্নয়ন কার্যক্রম ও সেবাগুলোতেও তাদের অভিগম্যতা নেই। ব্র্যাক তখন তাদের জন্য নতুন প্রজন্মের দারিদ্র্য হ্রাস কর্মসূচির উদ্যোগ গ্রহণ করে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ২০০২ সালে ব্র্যাক ‘আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’ নামে একটি বিশেষায়িত কর্মসূচি চালু করে। এই কর্মসূচি অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দীর্ঘ মেয়াদে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করে। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ২২ লাখের বেশি মানুষকে চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করেছে এ কর্মসূচি।
অন্যদিকে, এ সময়সীমায় সরকারও নানাবিধ সুরক্ষাসংবলিত আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ রকম একটি সফল কর্মসূচি হলো ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ কর্মসূচি। এর সঙ্গেও ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মিল রয়েছে। এ ছাড়া ‘সিঁড়ি’, ‘চর লাইভলিহুড প্রোগ্রাম’সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিচালিত সফল জীবিকায়ন কর্মসূচিতেও ব্র্যাকের এ কর্মসূচির মূল কাঠামো প্রতিফলিত হয়েছে। সরকারের গৃহীত জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলেও ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম পৃথিবীর ৫০টিরও অধিক দেশে সেসব দেশের সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্র্যাকের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই কর্মসূচি ব্র্যাক তথা বাংলাদেশের উদ্ভাবনী চিন্তার জগতে একটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত নাম। তবে ব্র্যাক এই সাফল্য নিয়ে থেমে নেই। সংস্থাটি নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে এই কর্মসূচির নবতর প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণের মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জ এবং কোভিড মহামারি বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। বিশেষ করে অতিদরিদ্ররাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাক তার আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভিযোজন ক্ষমতা, নগরকেন্দ্রিক সহনশীলতা বৃদ্ধিসহ নতুন নতুন মাত্রা যোগ করে চলেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্র্যাক দক্ষতা উন্নয়ন, কাজের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি, বৈদেশিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে। অতীতের মতো এই যাত্রাতেও ব্র্যাক সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ লক্ষ্যে সংস্থাটি যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে।
কে এ এম মোর্শেদ ঊর্ধ্বতন পরিচালক, ব্র্যাক
পলাশ দাশ পরিচালক, আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম, ব্র্যাক