প্রথম আলো ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই একটা স্লোগান ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রত্যেক কর্মীর অন্তরে এবং উচ্চারণে: ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো’।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশের মানুষ এই বার্তাকে ভালোবেসে আপন করে নেন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রথম আলোয় এসে তাদের বিতর্ক কিংবা বিজ্ঞান উৎসবের সঙ্গে থাকতে প্রথম আলোকে অনুরোধ করে এবং স্মরণ করিয়ে দেয় এই স্লোগানের কথা, ‘আমরা ভালো কাজ করছি, আপনাদের থাকতেই হবে। আপনারাই তো বলেন, যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো।’ দেশে বন্যা হয়েছে, প্রথম আলো অফিসে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এসেছেন সাধারণ মানুষ, ‘আপনারা এগুলো বিতরণ করার দায়িত্ব নিন,’ মানুষের এমন প্রত্যাশার কারণেই প্রথম আলো ট্রাস্ট গঠন করেছে, বন্ধুসভার মাধ্যমে বন্যায়, শীতে, সিডরে-আইলায় ত্রাণকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
একেবারে শুরুর দিনগুলোয়, সেই ১৯৯৮ সালে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রচারণার জন্য একটা বিজ্ঞাপনের অঙ্গীকার ছিল দলনিরপেক্ষতা। রমনা রেস্তোরাঁর একজন কর্মী দুটো কাগজ পড়তেন। এক কাগজে থাকত সরকারি দলের কথা, আরেকটায় বিরোধী দলের কথা। প্রথম আলো বলেছিল, প্রথম আলো কোনো দলের হবে না, হবে নিরপেক্ষ।
শুরুতে প্রথম আলো নিজেকে পরিচয় দিত ‘একুশ শতকের দৈনিক’ বলে। ঝকঝকে ছাপা, রঙিন পৃষ্ঠা, প্রতিদিন একটা করে ফিচার ক্রোড়পত্র, দলনিরপেক্ষতা, মননে ও চিন্তায় আধুনিকতা—একুশ শতকের দৈনিক হিসেবে প্রথম আলোকে পাঠক শুরু থেকেই গ্রহণ করে নিতে থাকেন।
প্রকাশের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম আলো হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পাঠকদের প্রিয়তম পত্রিকা। তখন প্রথম আলোর ট্যাগলাইন ছিল: ‘সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক’।
প্রথম আলোর আরেকটা জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘চোখ খুললেই প্রথম আলো, চোখ খুলে দেয় প্রথম আলো’।
২০০৮ সালে প্রথম আলোর এক দশক পূর্ণ হয়। সে বছর খুবই ঘটা করে প্রথম আলো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করে। স্লোগান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ‘বদলে যাও, বদলে দাও।’ নিজেকে বদলানোর কথাই বলা হয় বিশেষভাবে। প্রত্যেকে যদি একটু করে ইতিবাচকভাবে বদলে যাই, তাহলে দেশ এবং জগৎ অনেকটাই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সে বছর প্রথম আলোর কর্মসূচির মাধ্যমে বদলের শপথ নেন অনেক মানুষ।
‘বদলে যাও, বদলে দাও’, এই স্লোগান পরের বছরগুলোতেও অব্যাহতভাবে প্রচার করে গেছে প্রথম আলো। ২০০৯ সালের ৪ নভেম্বর রাজনীতি বিষয়ে বদলের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন, ‘পাল্টে দিন দেশের রাজনীতিকে।’
২০১১ সালের ৪ নভেম্বরে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির করুণ দশার প্রেক্ষাপটে আইরিন খান লিখলেন, ‘আর নীরব থাকা উচিত নয়।’ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বসন্তের অপেক্ষায়।’ যে অপেক্ষা হয়তো ২০২৪-এ এসে পূর্ণতা পেল। আর মুহাম্মদ ইউনূস সেই ২০১১ সালেই প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে লিখেছিলেন, ‘তরুণেরাই এগিয়ে থাকবে।’
ওই সময় প্রথম আলোর একটা প্রতিপাদ্য ছিল: ‘আসুন, দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসি’।
২০১২ সালে এসে আমরা দেখি, সারা পৃথিবীর ১৯৮টি দেশ থেকে প্রথম আলো পড়া হয় অনলাইনে। বিষয়টাকে বিবেচনায় রেখে প্রথম আলো স্লোগান নেয়: ‘বিশ্বজুড়ে বাংলা, বিশ্বজুড়ে প্রথম আলো।’
২০১৩ সালে প্রথম আলো আবারও আস্থা প্রকাশ করে তরুণদের ওপরে। বাংলাদেশের কর্মোদ্যোগী নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে ছাত্রদের ওপরে। আমরা বলি, ‘যত দিন তোমার হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।’ এই ‘তুমি’টা ছিল বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, তরুণ-যুবক, ছিল কৃষক এবং শ্রমিক। প্রবীণদের ওপরে নয়, ভরসা করতে হবে নতুনদের ওপরে, তা-ই ছিল প্রথম আলোর আবেদন।
তরুণেরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে কেবল তরুণ নেতৃত্ব। সে বিবেচনা থেকে ২০১৪ সালে প্রথম আলো স্লোগান নেয়, ‘কালকের পৃথিবীটা আমাদের হবে।’ ২০১৫-তে এসে প্রথম আলো বলল, ‘ধন্যবাদ, ৫৫ লাখ পাঠক’। কারণ, ওই সময় ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে থেকে জানা গেল, রোজ ৫৫ লাখ মানুষ পড়েন প্রথম আলো।
২০১৬-তে প্রথম আলোর ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে তরুণদের ওপর আস্থা আরও স্পষ্ট করা হলো। বলা হলো, ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি ৪ নভেম্বর ২০১৬-তে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে প্রকাশ করা হয়। উচ্চারণ করা হয়, ‘এ বয়স জেনো ভীরু কাপুরুষ নয়, পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে...’
প্রথম আলোর ওপর শাসকগোষ্ঠীর নানামুখী আক্রমণ বাড়তেই থাকে। কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না। ২০১৭ সালে এসে প্রথম আলো পাঠকের সামনে তার সাহসী সাংবাদিকতার অঙ্গীকার আবারও হাজির করে, ‘সাহসের ১৯ বছর।’
২০১৮ সালে পত্রিকাটি তার প্রথম দিককার অঙ্গীকার পাঠকদের আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘ভালোর সাথে আলোর পথে’।
২০১৯ সালে প্রথম আলোর ২১ বছর পূর্ণ হলো। তাই প্রথম আলো নিজেকেই যেন মনে করিয়ে দিল, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ এই বার্তার কারণ, প্রথম আলোর ওপরে শাসকদের চাপের সাঁড়াশি জোরদার হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। কিন্তু প্রথম আলোর অঙ্গীকার ছিল, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার প্রশ্নে মাথা নত করিনি, করব না!
২০২০ সালে পৃথিবীজুড়ে করোনা, অতিমারি, মৃত্যুভয়, আস্থার সংকট। প্রথম আলো আশ্বস্ত করতে চাইল মানুষকে, বলল, ‘আস্থা রাখি আলোয়’।
জেগেছে মানুষ, বৈষম্যহীনতার স্বপ্ন নিয়ে। রক্তের দামে মানুষ এনেছে মুক্তির সকাল, সামনে নিশ্চিত আলোকিত ভবিষ্যৎ। এই জাগরণ অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষকে জেগে থাকতে হবে। বাংলাদেশকে জেগে থাকতে হবে। জনতার সংগ্রামের সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছানোর জন্য টেকসই সংস্কার আনতেই হবে।
একের পর এক আক্রমণ আসতে লাগল প্রথম আলোর ওপরে। ১৭ মে ২০২১ গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে, তারপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে। শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেই নয়, দেশে-বিদেশে মানুষের অগ্রযাত্রার পথে বেশুমার বাধা। তবু মানুষ তো এগোবেই। মানুষের তো পরাজয় নেই। ২০২১ সালে প্রথম আলো বলল, ‘বাধা আসে, পেরিয়ে যাই।’ বাধার প্রাচীর পেরিয়ে মানুষের অগ্রযাত্রার উজ্জ্বল উদাহরণও তো পৃথিবীতে কম নেই। যেমন বিশাল বাংলার জনপদে জনপদে বাধা ডিঙিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার অনেক খবরই প্রথম আলো প্রকাশ করে যাচ্ছিল যত্নের সঙ্গে।
২০২২ সালে প্রথম আলো তার দুই যুগের প্রতিশ্রুতি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাইল, ‘সত্যে তথ্যে ২৪’।
২০২৩ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে মানুষদের মধ্যে ছিল হতাশা। ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিল শঙ্কা। কী বলবে প্রথম আলো? হতাশা ছড়ালে তো চলবে না। আশার কথা বলতে হবে। পরিবর্তনের কথা বলতে হবে। এবারও প্রথম আলো ভরসা রাখল এ দেশের তারুণ্যের ওপরে, সাধারণ মানুষদের ওপরে। নাজিম হিকমতের কবিতা থেকে সাহস নিল; দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে। বলল, ‘হারবে না বাংলাদেশ’।
যখন প্রথম আলো নভেম্বর ২০২৩-এ এই কথা বলে, তখন অল্প কজনই ভাবতে পেরেছিলেন, শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে মানুষই। জয়ী হবে মানুষের চাওয়া, মানুষের দাবি। হারবে না বাংলাদেশ। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে এসে দেখা গেল, প্রথম আলোর এই বিশ্বাস সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ হারেনি। জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে হেরে গেছে লৌহযবনিকার মতো নেমে আসা দুঃশাসন, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ।
তাই তো ২০২৪-এ এসে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান ‘জেগেছে বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশ জেগেছে। পরিবর্তনের ধারাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সংগ্রাম চলছে। এখানেও ভরসা ছাত্র তরুণেরাই। যত দিন এ দেশের মানুষ এবং তারুণ্য জেগে থাকবে, পথ হারাবে না বাংলাদেশ, হারবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জয় হবেই।
প্রতিবছর এই একটা কথা প্রথম আলোর সব কর্মী বলে এসেছেন, অন্তর থেকে বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, তা হলো প্রথম আলোর একটাই লক্ষ্য, একটাই এজেন্ডা, আর তা হলো বাংলাদেশের জয়।
বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আর তরুণেরা দেশে-বিদেশে সাফল্য আর বিজয় ছিনিয়ে আনছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক উদ্যোগ—বাংলাদেশের তরুণদের সাফল্যের তালিকা দীর্ঘ। দেশের ছাত্রসমাজ চিন্তায় এবং আন্দোলনে দিচ্ছেন নতুন পথের দিশা। এই সবকিছুর লক্ষ্য কিন্তু বাংলাদেশেরই জয়।
যে প্রবাসী বন্ধু মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে মগজগলা গরমে কাজ করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, যে নারী পোশাক কারখানার চোখধাঁধানো আলোর নিচে নিজের তারুণ্য নিবেদন করে দিয়ে ডলার আনছেন বিদেশ থেকে, তাঁরা সবাই বাংলাদেশের জয় চান। বাংলাদেশের কৃষকেরা দেশকে কৃষিতে স্বাবলম্বী করে চলেছেন অমানুষিক পরিশ্রম আর অসাধারণ উদ্ভাবনী দিয়ে। বাংলাদেশের কিশোরীরা আধাপেটা খেয়ে ফুটবল খেলে দেশকে এনে দিচ্ছে ফুটবলের চ্যাম্পিয়নশিপের কাপ। এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ প্রত্যেকে বাংলাদেশের জয়ই চান, সে জন্যই কাজ করে চলেছেন।
কিন্তু স্বার্থান্বেষী নীতিনৈতিকতাহীন শাসকেরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই অমিত সম্ভাবনা আর সাধনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছেন। সেই দুঃসময়ের অবসান ঘটাতে মানুষ জেগেছে। বাংলাদেশ জেগেছে। ব্যক্তিমানুষ আর সম্মিলিত মানুষের উদ্যোগকে দুর্নীতির স্রোতে ভেসে যেতে দেওয়া যাবে না আর। গণতন্ত্রহীনতা, মানবিক মর্যাদাহীনতা, সুশাসনের অভাবের দিনে বাংলাদেশ আর ফিরতে চায় না।
জেগেছে মানুষ, বৈষম্যহীনতার স্বপ্ন নিয়ে। রক্তের দামে মানুষ এনেছে মুক্তির সকাল, সামনে নিশ্চিত আলোকিত ভবিষ্যৎ। এই জাগরণ অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষকে জেগে থাকতে হবে। বাংলাদেশকে জেগে থাকতে হবে। জনতার সংগ্রামের সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছানোর জন্য টেকসই সংস্কার আনতেই হবে।
জেগেছে বাংলাদেশ, জেগে থাকবে বাংলাদেশ।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক