মাসের পর মাস ধরে কর্তৃত্ববাদের সমর্থক একজন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থেকেছেন এবং জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি সন্দেহের বীজ বুনে দিয়েছেন। নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত হওয়ার পর তাঁর সমর্থকেরা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করেন। কিন্তু এসব আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট শক্তি নিয়ে দাঁড়ায়। ফলে অভিষেকের দিনে শান্তিপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের মধ্যকার এ ঘটনাবলির সাদৃশ্য বেশ লক্ষণীয়। ব্রাজিলের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন, বদলে ট্রাম্প সমর্থন দিয়েছিলেন বলসোনারোকে। জো বাইডেন অবশ্য এতটা করেননি। কিন্তু বিরোধীরা যখন হইচই করছিলেন, সে সময় লুলা দা সিলভাকে স্বীকৃতি দেন তিনি। অভিষেক ভাষণে বাইডেন বলেছিলেন, ‘আমেরিকা ফিরে এল’। অবশ্য ‘ব্রাজিলের ফিরে আসা’ স্লোগান দুই বছর আগেই দিয়েছিলেন লুলা।
বাইডেন ও লুলার কাছে দেশের এই প্রত্যাবর্তনের মানে কী? বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ‘কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঠেকিয়ে বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।’ রাশিয়া ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ‘মুক্ত বিশ্বকে’ ঐক্যবদ্ধ করা। অন্যদিকে বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে লুলার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এর ভিত্তি হতে হবে সংলাপ, বহুপক্ষীয়বাদ ও বহু মেরুকেন্দ্রিকতা। বৈশ্বিক বিভাজন ও সংঘাতের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান। লুলা তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখব।’
সংলাপ, বহুপক্ষীয়বাদ ও বহু মেরুকেন্দ্রিকতা—এসব ধারণা বাস্তবে কীভাবে প্রয়োগ হবে? সংলাপের অর্থ হলো পররাষ্ট্রনীতির বদল। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে একঘরে করার নীতির বদলে কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন লুলা। এ কারণে বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানালে লুলার সমর্থকেরা সেটিকে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেন। ব্রাজিলের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেলসো অ্যামোরিম বলেছিলেন, ‘আমি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে। এ ধরনের পদক্ষেপ সমস্যা সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না কিন্তু গোটা বিশ্বের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে।’
লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের বিরাগভাজন দেশগুলোর ক্ষেত্রেও লুলা একই নীতি বজায় রেখে চলেন। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলসোনারো যেখানে ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত নেতা নিকোলা মাদুরোকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন, সেখানে লুলা তাঁর সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে তিনি কিউবাকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের সমালোচনা করেন।
২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলে নতুন বৈশ্বিক জোট ব্রিকস গঠনে লুলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর লুলা ব্রিকস সম্প্রসারণ এবং ডলারকে বাদ দিয়ে ব্রিকসের জন্য নতুন একটি লেনদেনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাবে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
বহুপক্ষীয়বাদ হলো একতরফা জবরদস্তির বিপরীত অবস্থান। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই লুলা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জাতিসংঘের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থার ভূমিকার কথা বলে আসছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও যায়। ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ায় লুলা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন।
লুলার কাছে ‘বহু মেরুকেন্দ্রিকতা’ হলো ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নতুন জোট গড়ে তোলা। এই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া পশ্চিমা বিশ্বেও শুরু হয়েছে। বহুদিন ধরে লাতিন আমেরিকার প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের বাইরে স্বাধীন একটা জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করে আসছেন লুলা।
বলসোনারো প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আঞ্চলিক জোট গঠন ও উদ্যোগ থেকে ব্রাজিলকে সরিয়ে নেন। লুলা ক্ষমতায় আসার পর কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও চিলির সমমনা সরকারগুলোর সঙ্গে স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, পরিবেশ ও অবকাঠামো খাতে একটি সমন্বিত আঞ্চলিক কাঠামো গড়ে তোলার আশা করছেন।
অবশ্য আলাদা জোট গড়ার লুলার এই অঙ্গীকার শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ‘গণতন্ত্র’-এর সঙ্গে ‘কর্তৃত্ববাদ’-এর সংঘাতকে সভ্যতার সংঘাত বলে মনে করেন বাইডেন। রাশিয়া ও চীন কর্তৃত্ববাদী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছে, এমন ধারণা তাঁর।
২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে মিলে নতুন বৈশ্বিক জোট ব্রিকস গঠনে লুলা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর লুলা ব্রিকস সম্প্রসারণ এবং ডলারকে বাদ দিয়ে ব্রিকসের জন্য নতুন একটি লেনদেনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাবে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
আগ্রাসন চালিয়ে সরকার উৎখাত করার কালো ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ব্রাজিল এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলে গণতান্ত্রিকভাবি নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভুত্থানে মদদ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের যুক্তি হলো, ব্রাজিলকে ‘১৯৬০–এর দশকের চীন হওয়া’ থেকে রক্ষা করেছিল। সেই কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক ২০১৬ সালে ব্রাজিলে সাংবিধানিক অভ্যুত্থানে মদত জোগায় যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে লুলাকে অবৈধভাবে ৫৮০ দিন কারাগারে থাকতে হয়।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডেভিড অ্যাডলার প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনালের সাধারণ সমন্বয়ক