মোহাম্মদ বিন সালমান স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ পাবে।
মোহাম্মদ বিন সালমান স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ পাবে।

মতামত

মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে গাজা যুদ্ধ

একসময় আশা করা হতো সৌদি আরব সাধারণভাবে আরব বিশ্বের এবং নির্দিষ্ট করে উপসাগরীয় দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিয়ে ফিলিস্তিন–সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান করবে। কিন্তু সেই আশা এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

সাত মাস ধরে ইসরায়েলের গণহত্যায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সৌদি আরবের দ্বিধাগ্রস্ত ও আন্তরিকতাশূন্য সমর্থন এটা দেখিয়ে দিল যে গাজা যুদ্ধে সৌদি আরব আর বাস্তবে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় নেই। এ যুদ্ধে ইসরায়েল তো তার প্রভু যুক্তরাষ্ট্রের কথা শুনছেই না, সেখানে উপসাগরীয় ধনী ও বন্ধু প্রতিবেশীদের কথা শোনার তো কোনো কারণই নেই।

ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ ফিলিস্তিন–সংকটে সৌদি আরবের অভিভাবকত্ব করার ভূমিকাটি সত্যি সত্যি শেষ করে দিয়েছে।

ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের যোগাযোগের ঘনিষ্ঠ পথ রয়েছে, সেখানে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি আরবের এ রকম বিচ্ছিন্ন ও বিশৃঙ্খল অবস্থানের পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ তো রয়েছে। আর সেই কারণটি হলো, সৌদি আরবের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ।

ইসরায়েলকে আর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেওয়া যায় না। এ অভিযানে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ২০ লাখের বেশি মানুষের ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের এ সময়টাতে আরব ও মুসলিম দেশগুলো ত্রাণ সংগ্রহ ও সেটা বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যস্ত থাকতে পারে না।

সৌদি আরব তার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘনিষ্ঠ মিত্রের জায়গায় রাখতে চায়। ফিলিস্তিনিদের ভদ্রস্থ জীবনযাপন ও দখলদারি থেকে মুক্তি চাইলে সেটা অর্জন হওয়ার নয়।

কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দুর্বিষহ দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে রেখে যুবরাজ সালমান সৌদি আরবের জাতীয় স্বার্থে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারেন না।

মোহাম্মদ বিন সালমান স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক করার বিনিময়ে ‘আয়রন ডোম’ পাবে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলের মজুত আছে, এমন দুটি স্থাপনায় হামলা করে হুতিরা। এই হামলা ঠেকাতে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেই স্মৃতি এখনো সৌদি যুবরাজকে অবশ্যই তাড়া করে ফেরে।

এর পর থেকে যুবরাজ সালমান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের একটি নিখাঁদ নিরাপত্তা চুক্তি করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু সেটা এখন পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি। গাজায় ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের এখন যেভাবে কচুকাটা করে চলেছে, তাতে করে আলাপ-আলোচনাটি শুধু স্থগিত করে রাখতেই হচ্ছে না, বাস্তবে সেটা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা মোটেই বিস্ময়কর ঘটনা নয়। দেশটির নেতৃত্ব এখন আর বিদেশের বিষয়াদিতে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বৈধতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন না, এখন তাঁরা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মূল মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখছেন।

আরব বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে সৌদি আরব সরে এসেছে; তার কারণ হলো মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর দেশে নিজের নেতৃত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৭ অক্টোবরের (হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়) মাত্র এক সপ্তাহ আগে সৌদি যুবরাজ ফক্স নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তাঁরা।

কিন্তু সাত মাস পর দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রীতিমতো বেকায়দায় পড়তে হয়েছে সৌদি যুবরাজকে। এর কারণ হচ্ছে, সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, ৯৬ শতাংশ সৌদি নাগরিক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধিতা করেছেন।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এখন এই ধারণা প্রচারে ব্যস্ত যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের বাধ্যবাধকতা নেই কিংবা তাড়া নেই।

সৌদি আরব সম্প্রতি বাইডেন প্রশাসনের কাছে জানিয়েছে যে ‘১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানীর স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত এবং গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া এবং সেখান থেকে সব দখলদার সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্কে যাবে না সৌদি আরব’।

এ ধরনের বাগাড়ম্বরের পুনরাবৃত্তি প্রথায় পরিণত করেছে সৌদি আরব। কিন্তু সন্দেহ আছে যে এই বাগাড়ম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠ সৌদি জনগণকে কিংবা ফিলিস্তিনিদের আশ্বস্ত করছে কি না।

অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জন্য অনুদান সংগ্রহের প্রচেষ্টাটি রাজনৈতিক রঙে চাপা পড়তে বসেছে। মুখ রক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে গাজার জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় সৌদি আরব। সাহেম নামে এই উদ্যোগে ১৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ সংগ্রহ করা হয়। সাহেমের ওয়েবসাইটে দাতাদের নাম প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করা হচ্ছে না। এ তালিকায় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি অ্যারামকোও রয়েছে।

খেজুর থেকে শুরু করে চিকিৎসার জন্য কী কী ওষুধপত্র দেওয়া হয়েছে, সেসবের তালিকা সাহেমের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় দাতব্যকাজ অবিস্মরণীয় প্রোপাগান্ডায় রূপান্তরিত হয়েছে।

এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে গাজার জন্য বিশাল মানবিক সহায়তা দরকার। সেটা জরুরি। সে কারণে এ ধরনের সহযোগিতার উদ্যোগ খুব প্রশংসনীয়ও। কিন্তু ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে সৌদি আরবের প্রোপাগান্ডা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে যে বাস্তবে রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার তার বিকল্প হতে পারে না।

ইসরায়েলকে আর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দেওয়া যায় না। এ অভিযানে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ২০ লাখের বেশি মানুষের ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের এ সময়টাতে আরব ও মুসলিম দেশগুলো ত্রাণ সংগ্রহ ও সেটা বিজ্ঞাপন প্রচারে ব্যস্ত থাকতে পারে না।

অন্য অনেক রাষ্ট্রের মতো সৌদি আরবও ত্রাণ ও মানবিক কাজের দৌড়ে ঢুকে পড়েছে। এটা সৌদি আরবের রাজনৈতিক অক্ষমতা তারই বহিঃপ্রকাশ।

সৌদি আরবের জাতীয় স্বার্থ আরব প্রতিবেশের মধ্যেই নিহিত, ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যা সমস্ত শান্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, অবশ্যই তার মধ্যে নয়।

  • মাদালি আল-রাশিদ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং প্রফেসর
    আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত