মতামত

খেলার মাঠ-গ্যালারিতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কেন এই গণজোয়ার

ফুটবল গ্যালারিতে ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে দর্শকেরা। স্কটল্যান্ড
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনি শিশুদের নির্বিচার হত্যা দেখে বিচলিত, অক্ষম ক্রোধে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যাই দুনিয়াতে বেশি। যাঁরা পাষাণ হৃদয়ের বা মানবাধিকার সবক দিয়ে কপটতায় ভোগেন, তাঁরা বাদে এই হত্যাযজ্ঞে অস্থির সময় কাটাচ্ছেন না এমন মানুষ খুবই কম।

কিন্তু কয়েক দিন আগে এক ভিডিও দেখে সেই কমসংখ্যক মানুষের মধ্যেও অনেকে হয়তো কেঁদেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেই ভিডিও কোনো হত্যাকাণ্ডের নয়, বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া প্রায় অভ্যস্ত লাশের ছবিও নয়। সে ভিডিও এক খেলোয়াড় টুর্নামেন্ট জেতার পর নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করার।  

ওনস জাবুর। তিউনিসিয়ার টেনিস খেলোয়াড়। প্রথম আরব নারী খেলোয়াড়, তিনি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনাল খেলে রেকর্ড করেছেন। আরব নারীদের টেনিসের মতো খেলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা জাবুরকে শুধু দারুণ খেলোয়াড়ি দক্ষতার কারণেই নয়, পাশাপাশি দারুণ একজন মানুষ হিসেবেও ভক্তেরা ভালোবাসেন। তিনি সব সময় হাসেন, জয় কিংবা পরাজয়ে উৎফুল্ল থাকেন। এ কারণে, তাঁকে আদর করে ডাকা হয় ‘হ্যাপিনেস মিনিস্টার অব তিউনিসিয়া’। গরিব দেশটার গর্বের প্রতীক তিনি।

অথচ সেই জাবুর অঝোর ধারায় কাঁদলেন মেক্সিকোর কানকুনে ডব্লিউটিএ টুর্নামেন্ট জেতার পর। মাইক হাতে অনুভূতি জিজ্ঞাসা করা প্রেজেন্টারকে বললেন, এই অবস্থায় মন ভালো থাকা যায় না। যখন শত শত শিশু মারা যাচ্ছে, তখন কেবল কান্নাই পায়। আমি আমার পুরস্কার জেতার টাকা ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য দিতে চাই। আপনারা ভাববেন এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা, এ কেবলই সামান্য মানবতা। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

গত ২৯ অক্টোবর পেশাদার এমএমএ-তে অভিষেক হয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সিং ফাইটার শাহ কামালির। অভিষেকেই তিনি গায়ে জড়িয়ে এসেছিলেন ফিলিস্তিনি পতাকা। প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডসের জিমি ফন বেমেলেনকে প্রথম রাউন্ডের এক মিনিট আট সেকেন্ডেই নক আউট করেন কামালি। এরপর বিজয়ীর মঞ্চে উঁচিয়ে ধরেন ফিলিস্তিনের পতাকা। সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাও ছিল।

লিভারপুল ফুটবল দলের কিংবদন্তি কোচ বিল শ্যাংকলি বলতেন, ‘অনেকে মনে করে ফুটবল জীবন আর মৃত্যুর সমান। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি ফুটবল এর চেয়েও বড়।’

তিউনিসিয়ার টেনিস খেলোয়াড় ওনস জাবুর গাজার শিশুদের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন

শ্যাংকলির আলাপটা অতিশয়োক্তি। জীবনের চেয়ে বড় কিছু হয় না। কিন্তু জীবনের জয়গান গাইতে খেলাধুলা অবিশ্বাস্য যন্ত্রসংগীত হয়ে ওঠে। আবার কে জানে, শ্যাংকলি হয়তো ভুলও নন। মানুষের জীবনের এক অদ্ভুত চাহিদা হচ্ছে জীবনকে ছাপিয়ে জীবনের ছাপ রেখে যাওয়া। স্পোর্টস সেই ছাপিয়ে যাওয়ার কাজটা করে। বিশ্বমানবতার সবচেয়ে নাজুক মুহূর্তে একজন দৃঢ়চেতা, হাসিখুশি নারীর কান্না সবাইকে কাঁদায়, উদ্বুদ্ধ করে সেই নাজুক সত্তাটিকে উদ্ধারে।

জাবুরের কিছুদিন আগে এই বাংলাদেশেই খেলায় জয়ের পর সেই উদ্ধারের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছিলেন আমাদের ফুটবলার বিশ্বনাথ ঘোষ। ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে বিজয় উদ্‌যাপন করেছিলেন দর্শকের অভিবাদনের জবাব দিতে গিয়ে।

জাবুর আরবীয় নারী, বিশ্বনাথ তৃতীয় বিশ্বের একজন হিসেবে সংহতি জানান, কিন্তু স্কটল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব সেল্টিকের ভক্তরা তো ইউরোপীয়। তথাপি তাঁরাও প্রমাণ করেন বিশ্বমানবতা এই সব জাতপাতের ধার ধারে না। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের মতো বড় আসরের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলায় গ্রিন ব্রিগেডরা নিজেদের মাঠের দর্শক গ্যালারি সবুজ করে তোলেন ফিলিস্তিনি পতাকায়। যুদ্ধ থামাও স্লোগানে মুখরিত করেন।

লিভারপুলের সমর্থকদের হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা

গত বছর বিশ্বকাপের কথাও নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। তখন এতটা নারকীয় পর্যায়ের হত্যাকাণ্ড চলছিল না, কিন্তু ৭৫ বছর ধরে আক্রমণ আর অন্যায়ের শিকার ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রতিটি খেলা শেষে পতাকা ওড়াত মরক্কো ফুটবল দল।

পশ্চিমা শক্তির পদানত ফিফা প্রায়ই এসব ঠেকিয়ে দিতে চায়। কিন্তু জরিমানার ভয় না পেয়ে, নিজেদের আর ক্লাবের ভবিষ্যৎ শঙ্কার মুখে পড়তে পারে জেনেও এই প্রতিবাদ চলতে থাকে।

কিন্তু কেন ফুটবল মাঠ? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও হিউম্যানিটিসের অধ্যাপক তামির বার-অন একজন ফুটবলপাগল মানুষ। তবে তিনি কেবল ফুটবল ভালোবাসেন না, তিনি ফুটবলকে দিয়ে রাজনীতি, সমাজ ও মানবিকতা বোঝার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টার ফসল ‘দ্য ওয়ার্ল্ড থ্রু সকার’ বইটি। সে বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন ফুটবলের মাঠ হচ্ছে শেষ গণতান্ত্রিক জায়গা, যেখানে জনতা একত্র হয়ে নিজেদের এমনভাবে প্রকাশ করে, যা বাইরে নানা রকম বিধিনিষেধ ও গণতন্ত্রহীনতায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

শাহ কামালি অভিষেক ফাইটেই গায়ে জড়িয়ে আসেন ফিলিস্তিনি পতাকা

ফুটবলের সঙ্গে কেউ কেউ ধর্মাচরণের মিল পান। কানাডীয় দার্শনিক মার্শাল ম্যাকলুহান বলতেন, আমাদের কোটি কোটি বছর ধরে যেসব আবেগ গড়ে উঠেছে, ফুটবলে তার সবটা প্রকাশ করা যায়। বিপক্ষ দলকে শিকার করা, নিজের দুর্গ সামলানো। সেই কাজ করতে গিয়ে একটা দল হয়ে ওঠা, যাতে ভ্রাতৃত্ববোধ আর সহমর্মিতার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মানবিক বোধ শাণিত হয়। আবার ফুটবল চরম এক অনিশ্চয়তার খেলা, এই আধুনিক যুগে এসেও গোল বলটার গতিবিধি নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এক মুহূর্তের ভুলে বা শিথিলতায় নেমে আসতে পারে বিপর্যয়। এ যেন শিকারি সংগ্রাহক জীবনের যূথবদ্ধ জীবনেরই ছবি। ফুটবল মানুষকে সেই বাঁধনে জড়ায়।

যে কারণে, ইপি থম্পসনের মতো ইতিহাসবিদেরাও শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির জন্য ফুটবল ও ফুটবল ক্লাবের গুরুত্ব নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখেন। পুঁজিবাদের চাহিদায় নিজের ভূমি, জীবনযাত্রা থেকে উৎখাত হওয়া ছিন্নমূল মানুষেরা নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে পান এই সব ক্লাবের মাধ্যমে। খেলার মাঠে উল্লাস করার সময় ঘুচে যায় বিভেদ, গড়ে ওঠে এক অদ্ভুত আত্মার বন্ধন। ইংরেজদের দেশে যাওয়ার দরকার নেই, মোহামেডান আর ইস্টবেঙ্গলের ইতিহাস ঘাঁটলেই এর গুরুত্ব বোঝা যায়। গত শতকের ত্রিশের দশকে পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের গর্ব দিয়েছিল মোহামেডান আর উদ্বাস্তুদের জীবনের বাতিঘর ছিল ইস্টবেঙ্গল।

স্কটল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব সেল্টিকের ভক্তদের হাতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বিশাল ব্যানার

শুধু কি তাই? অরওয়েল বলতেন, আন্তর্জাতিক খেলাধুলা হচ্ছে গোলাগুলি ছাড়া যুদ্ধ। বাঙালির ক্লাব মোহনবাগান যখন গোরা সাহেবদের দলকে হারিয়ে শিল্ড জেতে, গোটা দেশের তরুণেরা বিশ্বাস করে মাঠে যেহেতু হারানো গেছে, রাজনীতির মাঠেও ওদের হারানো যাবে। মুক্ত হবে স্বদেশ ভূমি। এই বিশ্বাসটা মানবসমাজ গঠনের সবচেয়ে জরুরি উপাদান। এই সম্মিলিত বিশ্বাস হচ্ছে প্রগতির শকটকে এগিয়ে নেওয়ার জ্বালানি। একই সঙ্গে আত্মপরিচয় নির্মাণ আর তুলে ধরার মঞ্চ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

লিভারপুলের সমর্থকেরা তাই যখন সাম্রাজ্যবাদী রানির বিরুদ্ধে স্লোগান দেন, তা বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। হিটলারের বিরুদ্ধে জীবন হারানো নিশ্চিত জেনেও ডায়ানোমো কিয়েভের খেলোয়াড়েরা হারতে রাজি হয় না। জীবনের চেয়ে সম্মান অনেক বড়, মৃত্যুদণ্ড উপভোগ করার সময়েও এই মাথা উঁচু করে রাখা অত্যাচারীকে দুর্বল করে দেয়। কিয়েভের সেই ডেথ ম্যাচের খেলোয়াড়েরা আর গাজার অসহায় কিন্তু আত্মগর্বিত মানুষদের মিলটা সহজেই চোখে পড়ে।

ফুটবল অধিকার আদায়েরও এক দারুণ হাতিয়ার। ব্রাজিলের নান্দনিক ফুটবলার সক্রেটিস আর তাঁর ক্লাব করিয়েন্থেস স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবিসংবলিত জার্সি পরে খেলতে নামতেন। ২০ লাখ দর্শকের সামনে এক জনসভায় সক্রেটিস সামরিক জান্তার উদ্দেশে বলেছিলেন, হয় জনগণকে ভোটাধিকার দাও, না হয় আমি দেশ ছেড়ে ইতালিতে খেলতে চলে গেলাম। সেই হুমকিতে বাধ্য হয়ে নির্বাচন দিতে হয়েছিল স্বৈরাচারকে। ব্রাজিলে ফিরে এসেছিল গণতন্ত্র।

সক্রেটিসের কথা যখন এসেই গেল, স্মরণ করতে হয় ম্যারাডোনাকেও। তাঁর বন্ধু তালিকায় ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো, হুগো শাভেজ, ইভো মোরালেসের মতো বিপ্লবী রাজনীতিবিদেরা।এই ফুটবল জাদুকর নিজেকে ‘মনেপ্রাণে একজন ফিলিস্তিনি’ মনে করতেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গেও তিনি দেখা করেন। ইসরায়েলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের জন্য তিনি ব্যথিত হতেন। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর হামাসের মুখপাত্র শোক প্রকাশ করেছিলেন। এক টুইটে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের প্রতি আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সমর্থনের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে হামাস।

ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে আমাদের ফুটবলার বিশ্বনাথ ঘোষ

তামের বারের কথা তো বলাই হলো, এদুয়ার্দো গালিয়ানো, ফ্রাংলিন ফোয়ের, গ্যাব্রিয়েল কুনের মতো লেখকেরা রাজনীতি আর ফুটবল নিয়ে দারুণ সব বই লিখেছেন। গাদা গাদা একাডেমিক রচনা হয়েছে ফুটবল তথা স্পোর্টসের এই শক্তি নিয়ে।

আগুনে যেমন রান্না করা যায়, মানুষও তো হত্যা করা যায়! মুসোলিনি, ফ্রাংকো, ভিদেলা কিংবা বলসোনারোর মতো গণহত্যাকারীরা সেই কাজটাও করেছেন। করিম বেনজেমা, মেসুত ওজিল, মারিও বালাতোল্লিরা দারুণ খেলোয়াড় হলেও শিকার হন কুৎসিত বর্ণবাদের। ধর্ম যেমন প্রশান্তি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার স্পৃহা জোগায়, তেমনি একে ব্যবহার করে হীনস্বার্থ আর হানাহানিও তো চলছে সেই আদিকাল থেকে।

কিন্তু জাবুরের কান্না, বিশ্বনাথের পতাকা উঁচিয়ে ধরা, সেল্টিক সমর্থকদের অনবদ্য ভ্রাতৃত্ববোধ আমাদের সাহস দেয়। ক্রমশ দ্বীপের মতো একা হতে থাকা মানুষকে বার্তা দেয়, মানুষ হতে মানুষ আসে বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়, তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ, তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

  • সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক