২০২২ সালের গ্রীষ্ম ও শরৎকালজুড়ে বড় একটা আলোচনার বিষয় ছিল যুদ্ধে যখন জিততে পারবেন না, তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মুখ রক্ষা করে কীভাবে পালাতে পারেন, এমন একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। এখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যখন তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে, তখন যে প্রশ্নটি ধীরে ধীরে বাড়ছে সেটা হলো, ইউরোপের মুখ রক্ষার জন্য একটা পথ খুঁজে বের করা দরকার।
দুই বছরের নিষ্ঠুর যুদ্ধের পর ইউক্রেনে যে মানবিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা অপূরণীয়। এই দুই বছরে সেখানকার জনসংখ্যা কমেছে। সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণহানির ঘটনায় যেমন আবার আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচতে শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার কারণেও। এই ক্ষতি পূরণ করা ইউক্রেনের জন্য কঠিন হবে। আর যুদ্ধের অভিঘাতে ইউক্রেনের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি এখনই পঙ্গু হয়ে গেছে।
এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধের যে ব্যয়ভার, সেটা বিস্ময়করভাবে বেড়ে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ সম্প্রতি যে যৌথ মূল্যায়ন করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এর অর্থ হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের জন্য আগামী চার বছর ধরে যে অর্থের বরাদ্দ দিয়েছে, এক বছরেই ইউক্রেনের তার দেড় গুণ অর্থ প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নীতি নিয়ে বিতর্কের মঞ্চ মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স বার্ষিক ঝুঁকি সূচক প্রকাশ করে। ২০২৩ সালের সূচকে দেখা গিয়েছিল, জি-৭ ভুক্ত সাত দেশের মধ্যে পাঁচ দেশই রাশিয়াকে তাদের নিরাপত্তাঝুঁকি বলে মনে করছে। কিন্তু ২০২৪ সালের সূচক বলছে, জি-৭-এর মাত্র দুটি দেশ রাশিয়াকে তাদের দেশের জন্য ঝুঁকি বলে মনে করছে।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পাওয়ার দিক থেকে ইউক্রেন জি-৭-এর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ায় এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক ঘটনা। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য নিজ নিজ দেশের জনগণের সমর্থন আদায় করা ইউরোপের রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ফ্রান্স ও জার্মানির ভোটাররা পুতিনের পরিকল্পিত ইউক্রেন যুদ্ধের চেয়ে গণ-অভিবাসন ও উগ্রবাদী মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
এ ছাড়া পশ্চিমাদের সম্মিলিত মনোযোগের একমাত্র কেন্দ্র ইউক্রেন নয়। গাজা যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিস্তার পাওয়া সংঘাত এখন পশ্চিমাদের অ্যাজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক সমস্যা রয়েছে, যেটা বৈশ্বিক সংবাদের শিরোনাম হয় না।
সুদানের গৃহযুদ্ধ, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোয় বাড়তে থাকা সংঘাত, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যকার উত্তেজনা—এ সবকিছুই পশ্চিমা দেশগুলোর জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে যে অভিবাসীর নতুন ঢেউ শুরু হবে কি না।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মহড়া, ইরানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি যোদ্ধা গোষ্ঠীদের কর্মকাণ্ডও পশ্চিমাদের উদ্বেগের কারণ। আর উত্তর কোরিয়া, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে যে ‘শয়তানের অক্ষ’ তৈরি হয়েছে, তা পশ্চিমা বিশ্বের রাজধানীগুলোকে বিচলিত করছে।
এ প্রেক্ষাপটের বাইরেও আরেকটা কারণ এখন ইউক্রেনের জন্য দুঃখের একটা প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। ইউরোপের দেশগুলোর অনেক নেতা এখন এই উদ্বেগে আছেন যে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন হবে। তাতে করে ট্রান্স আটলান্টিক অ্যালায়েন্স বা ন্যাটো জোটের সমাপ্তি রচিত হতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেন থেকে সমর্থন তুলে নেয় তাহলে যুদ্ধটা চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপের সামনে যে চাপ এসে পড়বে, সেটা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি।
লড়াইয়ের গতিমুখ এখন যে দিকে তাতে করে ইউক্রেনের পরাজয় ঠেকানো কঠিন। সম্প্রতি মার্কিন টিভি উপস্থাপক টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন তাঁর বিজয়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলেছেন। প্রতিরোধের সক্ষমতা কমে গেলে পুতিনের সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যেতে পারে।
১৭ ফেব্রুয়ারি মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন যে গত কয়েক মাসে সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে অনেক ভুগতে হচ্ছে। রুশ বাহিনীর হাতে আভদিবকা শহরের আসন্ন পতন তারই দৃষ্টান্ত।
এই পরাজয়ের কারণে ইউক্রেনীয় বাহিনীর ফ্রন্ট লাইন কয়েক শ মিটার পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া আর যে বড় ক্ষতি হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কিন্তু এই পরাজয়ের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমাদের ওপরেও এর প্রভাব পড়ছে। কেননা, পশ্চিমা জনমনে এই চিন্তাটা আসতে শুরু করেছে যে যুদ্ধ জয়ের ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা টেকসই কি না।
লড়াইয়ের গতিমুখ এখন যে দিকে তাতে করে ইউক্রেনের পরাজয় ঠেকানো কঠিন। সম্প্রতি মার্কিন টিভি উপস্থাপক টাকার কার্লসনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পুতিন তাঁর বিজয়ের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলেছেন। প্রতিরোধের সক্ষমতা কমে গেলে পুতিনের সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যেতে পারে।
ইউক্রেনীয়দের পরাজয় পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক রকম অপমান। রাশিয়ার বিজয় হবে বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর বড় একটা আঘাত। সে ক্ষেত্র বিশ্বব্যবস্থা এমন একপর্যায়ে প্রবেশ করবে, যেটা মোটেই পশ্চিমাদের পক্ষে হবে না।
সে ক্ষেত্রে শীতল যুদ্ধের দুই শিবিরের মধ্যকার সংঘাতের প্রত্যাবর্তন হতে পারে। কিন্তু এবার সম্ভবত চীনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার শক্তিশালী শিবিরের সঙ্গে দুর্বল ও কম ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমা জোটের সংঘাত ফিরে আসবে। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো জটিল সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ একেবারেই কম দিতে হবে।
এ পরিস্থিতি বৈশ্বিক দক্ষিণের সেই সব দেশের জন্যও হুমকি তৈরি করবে, যারা ইউক্রেনের পক্ষে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে।
একটা বেরোনোর পথ খোঁজার মানে অবশ্য এই নয় যে পুতিনকে জিততে দেওয়া। এর অর্থ হচ্ছে ইউক্রেন এখন যতটা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে, তার প্রতিরক্ষা সুনিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে আরও বেশি পশ্চিমা সমর্থন দরকার হবে, কিন্তু অস্ত্রবিরতির জন্য একটা বন্দোবস্তে আসা বিষয়টি আন্তরিকভাবে বিবেচনা করা দরকার। আর লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি মানে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর শক্তিশালী নিরাপত্তা গড়ে তোলার সময় পাওয়া।
স্টেফান উলফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত