বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা অনেক বেশি। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে নিজের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। বিজ্ঞানে অগ্রগতির জন্য সমন্বয় কেন প্রয়োজন, তা নিয়ে লিখেছেন জেবা ইসলাম সেরাজ, আবিদুর রহমান, ইশরাত জাবিন, মুহাম্মদ মনজুরুল করিম, আরাফাত রহমান, মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, জামিলুর রহমান, আবদুল করিম, আহমেদ আবদুল্লাহ আজাদ, বোরহান উদ্দিন ও হাসিনা খান
বর্তমান যুগের বিজ্ঞান গবেষণার মূলমন্ত্র হলো মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির ব্যবহার। জীববিজ্ঞানও এর ব্যতিক্রম নয়। এ জন্য সম্প্রতি জটিল জীববিজ্ঞানবিষয়ক সমস্যা সমাধানের জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এর সবচেয়ে অপূর্ব উদাহরণ হচ্ছে চলতি বছরের পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার।
এই দুই বিভাগেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটেশনাল প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ছিল। বিশেষ করে জীববিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন নির্ধারণের মতো জটিল বিষয়ে কম্পিউটার সায়েন্স কতখানি সহায়ক হতে পারে। এর হাত ধরেই ভবিষ্যতে সিনথেটিক বায়োলজি ব্যবহার করে আরও কর্মদক্ষ প্রোটিন তৈরি করা হবে, যা অনেক জটিল জৈবিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে।
কাজেই এটা পরিষ্কার যে বর্তমানে জীববিজ্ঞান গবেষণা মাল্টিডিসিপ্লিনারি রূপ নিয়েছে এবং এই বহুমাত্রিক পদ্ধতিই ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, চিকিৎসা, কৃষি কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে জীববিজ্ঞানের ব্যাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা কিংবা একটি নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীরা ছাড়া অন্য কোনো ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীদের সমস্যার সমাধানে দরকার নেই, এমন ধারণা করা এই আধুনিক যুগে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ।
দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে আমরা জীববিজ্ঞান গবেষণাকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করে ফেলেছি। যেমন চিকিৎসা, কৃষি, প্রাণরসায়ন, অণুজীববিজ্ঞান, মলিকুলার বায়োলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি। কিন্তু যেকোনো জীববিজ্ঞানের সমস্যা সমাধানে এই বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত থাকে। বিশেষ করে কৃষি, প্রাণরসায়ন, অণুজীববিজ্ঞান এবং জিনপ্রযুক্তি ওপরের অনেক বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত এবং এরা একে অপরের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
এই পরিস্থিতিতে কেউ যদি দাবি করে একটিমাত্র শাখার বিজ্ঞানীরাই উদ্ভিদ, প্রাণী বা মানুষের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধে একমাত্র উপযুক্ত তা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর; বরং জীববিজ্ঞানের সব শাখা, কম্পিউটার সায়েন্স এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একীভূতকরণের মাধ্যমেই বাংলাদেশের জীববিজ্ঞানকে বৈশ্বিক মানে উন্নত করা সম্ভব। তাই বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীদের বিভক্ত না করে ঐক্যবদ্ধ করাই বাংলাদেশের বিজ্ঞান সম্প্রসারণ এবং বৈশ্বিক মানে পৌঁছার জন্য অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগকে আলাদা করে দেখার প্রবণতা অনেক বেশি। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে নিজের বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এ কারণেই বাংলাদেশে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের মধ্যে ফলপ্রসূ বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে না।
উদাহরণস্বরূপ কৃষিবিদ, মলিকুলার বায়োলজিস্টস, জিনবিজ্ঞানী, অণুজীববিজ্ঞানী এবং পরিসংখ্যানবিদদের মধ্যে সহযোগিতার অভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। যদিও বাংলাদেশে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণার সম্ভাবনা অনেক বেশি, কিন্তু বিভিন্ন বিভাগের গবেষণায় জ্ঞানের লেনদেনের অভাবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণাপত্রগুলো উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশে হিমশিম খান।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশ ও জাপানের মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোতে এর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায়। এসব–সম্পর্কিত ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীরা একই প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করেন গবেষণার উৎকর্ষের জন্য। উদাহরণস্বরূপ ২০০৩ সালে প্রকাশিত মানব জিনোম প্রকল্পের সফলতার পেছনে জীববিজ্ঞানী, জিনতত্ত্ববিদ, কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদ—সবার সমান অবদান ছিল। এই উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে বৃহৎ বৈজ্ঞানিক সাফল্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত প্রচেষ্টা খুবই প্রয়োজনীয়। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে এ ধরনের সমন্বিত প্রচেষ্টার খুবই অভাব, যার প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের গবেষণার সামগ্রিক মানে।
একই ধরনের অসহযোগিতার চিত্র বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিজ্ঞানীদের মধ্যেও লক্ষণীয়। যদিও অন্যান্য দেশে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা হয়। ধরা যাক, একজন হেপাটাইটিস সি রোগীর সমস্যার কথা। রোগনির্ণয় করার জন্য চিকিৎসকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ তৈরিতে দরকার ফার্মাসিস্ট, প্রাণরসায়নবিদ, রসায়নবিদ, কম্পিউটারবিজ্ঞানী ও অণুজীববিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত একটি বড় গবেষণা দল। সুতরাং সর্বোত্তম রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য চিকিৎসক এবং অন্যান্য ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে এ ধরনের সহযোগিতা এখনো বিরল।
বাংলাদেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেখানে জীবভিত্তিক সমস্যা সমাধানের জন্য একাধিক ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীরা একসঙ্গে কাজ করছেন তা হলো ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (এনআইবি)। আমরা খুবই হতাশ হয়ে লক্ষ করেছি যে এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ আছে। বায়োটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের একজন বিজ্ঞানীর নতুন মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদানও বাতিল হয়ে গেছে।
আমরা মনে করি, এনআইবির মহাপরিচালক অথবা যেকোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদের নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে স্বচ্ছতার সঙ্গে পদস্থ ব্যক্তির বৈজ্ঞানিক যোগ্যতা এবং তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থানের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে জীববিজ্ঞানের যেকোনো ডিসিপ্লিনের বৈজ্ঞানিক যোগ্যতাসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞানী এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য। এটা বলা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর যে শুধু বায়োটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের একজন বিজ্ঞানীকেই এনআইবির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
এনআইবির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে ৪০ শতাংশ বায়োটেকনোলজিস্টস, ২২ শতাংশ প্রাণরসায়নবিদ, ১৪ শতাংশ অণুজীববিজ্ঞানী, ১২ শতাংশ কৃষিবিদ, ১০ শতাংশ উদ্ভিদবিদ এবং ২ শতাংশ প্রাণিবিজ্ঞানী এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। কাজেই ‘বায়োটেকনোলজিস্টসরা এনআইবিতে বৈষম্যের শিকার’ বলে যে দাবি তোলা হয়েছে, তা আসলে প্রশ্নবিদ্ধ।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণায় বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ব্যানবেইসসহ বিভিন্ন গবেষণা ফান্ডিং এজেন্সি বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়নের আবেদনের সময় উল্লেখ করে দিতে পারে যে ভিন্ন ভিন্ন বিভাগের গবেষকদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে তৈরি গবেষণা প্রকল্পের আবেদন অগ্রাধিকারমূলকভাবে বিবেচনা করা হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত গবেষকদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও জ্ঞান বিনিময়ে উৎসাহিত করবে বলে আশা রাখা যায়।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সোসাইটি ফর গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশি বায়োটেকনোলজিস্টস (জিএনওবিবি) এনআইবি প্রতিষ্ঠার নির্দেশিকা প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। জীববিজ্ঞানের সব শাখার বিজ্ঞানীরা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কৃষিবিদ, চিকিৎসক, বায়োকেমিস্ট, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, প্রাণিবিজ্ঞানী, অণুজীববিজ্ঞানী, মলিকুলার বায়োলজিস্টস, বায়োটেকনোলজিস্টস, এমনকি কম্পিউটারবিজ্ঞানী এবং পরিসংখ্যানবিদেরা জিএনওবিবির সদস্য। তাঁরা সবাই একযোগে কাজ করছেন বাংলাদেশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিজ্ঞানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য।
জিএনওবিবি বাংলাদেশি জীববিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকে বাংলাদেশ এবং বিদেশে প্রচারে সহায়তা করে। এ ছাড়া জিএনওবিবি বাংলাদেশে এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী গবেষণাকর্মের জন্য জিএনওবিবি স্বর্ণপদক প্রদান করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম এবং সব ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞানীদের একত্র করার যে প্রচেষ্টা, তা প্রমাণ করে যে জিএনওবিবি বাংলাদেশে মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিজ্ঞানের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টাবদ্ধ।
জিএনওবিবি বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের বিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কোনো বিকল্প নেই। জাতির এই ক্রান্তিকালে বিভক্তির চেয়ে ঐক্য অপরিহার্য। পরিবেশগত বৈচিত্র্য যেমন স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে, তেমনি জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিজ্ঞানীদের সহযোগিতার মাধ্যমেই একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার উৎকর্ষ আনা সম্ভব।
লেখকেরা জিএনওবিবির কার্যনির্বাহী পরিষদের বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন