গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কি বৈষম্য সৃষ্টি করছে?

২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য জিএসটি সিস্টেমে ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের আশা জাগিয়ে ছিল। কারণ, শিক্ষার্থীরা কম ভোগান্তিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে, যা তাদের উচ্চশিক্ষাকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সব বিশ্ববিদ্যালয় একগুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় না আসায় সেই আশা পূরণ হয়নি, যা আমাদের হতাশও করছে। কারণ, শিক্ষার্থীকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-১৯৭৩–এ পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা পরীক্ষা নিচ্ছে, যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো না আসায় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা শতভাগ সফল হচ্ছে না। তাই সরকারকে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কষ্ট কমে যাবে। শিক্ষার্থীদের এখনো পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুলতে হয় এবং পরীক্ষা দিতে হয়। তাই আগের মতো ভোগান্তি থেকে যায়। যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির এ পরীক্ষায় একটি আবেদনে গুচ্ছের আওতাভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকছে, তা ইতিবাচক দিক।

প্রথমবার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নানা অসংগতি ছিল। যেমন কেন্দ্র জটিলতা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নানাভাবে আবেদনের ফি নেওয়া, ফলাফলে জটিলতা এবং আসন খালি থাকা ইত্যাদি। আসন খালি রেখে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়েছে গত বছর, যা ঠিক হয়নি। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন অনেক মূল্যবান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে একজন শিক্ষার্থীর জীবনই বদলে যায়। যেসব শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।

তাই শিক্ষার্থীদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হয়নি। এ বছর যেন একটি আসন খালি রেখেই ভর্তি কার্যক্রম শেষ না হয়। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ক্লাস ৭ সেপ্টেম্বর শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে ১ নভেম্বর ক্লাস শুরু হয়, যা সুখবর। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য যারা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে। কারণ, তারা বৈষম্যর সম্মুখীন হচ্ছে। তারা একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হয়ে ক্লাস শুরু করতে পারেনি। আর অন্যরা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে।

এমনকি গুচ্ছতে অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়নি এখনো। এটাই বৈষম্য সৃষ্টি। অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে হতাশা কাজ করছে। কারণ, তার সহপাঠী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছে, আর সেখানে তার ভর্তির সুযোগ অনিশ্চিত। তাই দ্রুত গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় আরও বৈষম্য হবে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তাদের এক সেমিস্টারের ক্লাস শেষ হবে, আর অন্যদিকে ক্লাস শুরু হবে, যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। গুচ্ছ থাকলে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভর্তি পরীক্ষায় হওয়া উচিত।

যদিও এটা কঠিন। তারপরও সম্ভব। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেই একমাত্র গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে। যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের প্রত্যাশা পূরণ হবে, যা দেশের মঙ্গলের জন্য একান্ত জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দেয় কর্তৃপক্ষ, যা হওয়া উচিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একধরনের। যেমন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তির জন্য একধরনের ফি এবং ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের জন্য একধরনের ফি। অর্থাৎ ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের যেকোনো বিষয়ে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে একই ভর্তি ফি হওয়া উচিত। তা না হলে এখানেও বৈষম্য সৃষ্টি হবে।

অতীতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য একেক জেলায় বা বিভাগে শিক্ষার্থীদের ছুটতে হতো। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণক্লান্তি বা অসুস্থতার জন্য প্রস্তুতি থাকার পরও অনেকের পরীক্ষা আশানুরূপ হতো না। তাই গুচ্ছ পদ্ধতি সবার জন্যই স্বস্তির বিষয়। অর্থাৎ একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা, যা প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হবে। ফলে সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের সঙ্গে পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারলে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে বলে মনে করি।

অনেক শিক্ষার্থীও মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক নয়। তারা মনে করে, সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে সবচেয়ে ভালো হতো। নতুবা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অজুহাতে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় ভবিষ্যতে না–ও থাকতে পারে। তবে নতুন এই ব্যবস্থাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত মনে করছেন বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক।

আশা করছি, এই পদ্ধতিতে পুরোনো সমস্যাগুলো দূর হতে পারে। এ ছাড়া গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক হলো, যদি কোনো শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাবশত পরীক্ষা মিস করে বা পরীক্ষায় বেশি খারাপ করে ফেলে, তাহলে তার গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আর থাকছে না। আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খারাপ করলেও আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ভালো পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে। গত শিক্ষাবর্ষে আমার বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষার্থী ময়মনসিংহ বিভাগের।

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীকে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ফরম কিনতে হয়। ফলে ব্যয় বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় একটি সিস্টেমে হওয়া দরকার। যেখানে শুধু একবার আবেদনের ফরমের টাকা দেবে। তারপর ভর্তির সুযোগ পেয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। তাহলেই ভোগান্তি কমবে।

দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩টি। ২২টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ৩ দিনে ৩টি ইউনিটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তিন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয় এক দিনে। এ ছাড়া কৃষি ও কৃষিপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয় কৃষিভিত্তিক গুচ্ছ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই, যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় না আসে, তাহলে আগের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত বলে মনে করছি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ফিরে আসবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিকতা বন্ধ হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প সময়ে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করতে পারত।

  • ড. মো. শফিকুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ