অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

মতামত

নতুন বছরে শিশুকালটা নিরাপদ থাকুক

কোভিড মহামারির ঘোর দুঃসময়ে দুটি বছর বিদায় নেওয়ার আগেই বাতাস ভারী হয়ে যেত প্রিয়জন বিচ্ছেদের কষ্টে। সেই দুঃসময়টা আমরা পেছনে ফেলে এসেছি, অথচ এ বছরের শেষে এসেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বছরটির বারোমাসি যাত্রায় পর্দা নামার আগেই অসংখ্য মানুষের জীবনেও আচমকা পর্দা পড়ে গেছে। এক ফিলিস্তিনের গাজাতেই মাত্র দুই–আড়াই মাসে আট হাজার শিশুর জীবন হারিয়ে গেল কিছু শক্তির অমানবিকতা আর দম্ভের বলি হয়ে।

সারা বিশ্বের দিকে তাকালে অকারণে হারিয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাটা নিষ্ঠুর রকমের হৃদয়বিদারক হবে। আমাদের দেশেও রাস্তায় ঝরেছে, পুকুরে ডুবে হারিয়েছে অনেক শিশুর প্রাণ। এই সেদিন রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়ে চলন্ত ট্রেনে মায়ের বুকে মিশে থেকে মায়ের সঙ্গে আগুনে দগ্ধ হলো এক শিশুর ছোট্ট শরীর।

বছর শেষে বীভৎসতার এই সালতামামি আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। সামনের বছরটা নিয়ে তাই আমরা আশাবাদী হতে পারি না। আগামী বছরটা যেন শিশুদের, তাদের থেকে বড়দের, তাদের পিতা–মাতা ও প্রতিবেশীদের সুন্দরভাবে কাটে, সে রকম একটা প্রার্থনা জানাতেও অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। তারপরও আমাদের ভেতর যে একরোখা এক আশাবাদী থাকে, তার কণ্ঠ ধার করে বলতে হয়, আসে দিন নিশ্চয় ভালো হবে। সহিংসতা আর বীভৎসতা—এসবের সঙ্গে শিশুদের কোনো সংযোগ আমরা দেখতে চাই না। নিশ্চয় প্রতিদিন একটু একটু করে এসব দূরের গল্প হতে থাকবে।

আমি জানি, এই দূরের গল্প এবং হাসি-আনন্দের কাছের গল্পটাও আমরা আমাদের মতো করে নিতে পারিনি শুধু আমাদের জন্যই। এ জন্য প্রকৃতি কিছুটা দায়ী, কাছের–দূরের নানা শক্তি, ঘটনাপাত আর ঘটকেরা কিছুটা দায়ী, নিয়তি বলে মানুষ যাকে বিশ্বাস করে, সেই দাবার ছক উল্টে দেওয়া অদৃশ্য ঘোড়সওয়ার কিছুটা দায়ী, কিন্তু মূল দায়টা আমাদেরই।

একটা ছোট্ট দেশ, যার গায়ে গায়ে লাগানো জনপদ, পিঠে-কোলে উপচে পড়া বাড়িঘরে মানুষকে যেখানে না চাইলেও নানা ধর্ম, শ্রেণি, বর্ণ আর মনের অন্য মানুষকে প্রতিদিন স্পর্শ করতে হয় হাত দিয়ে না হলেও দৃষ্টি দিয়ে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দিয়ে, সেখানে কেন এত বিভেদ-হিংসা, হানাহানি আর অমঙ্গল কামনা? নিঃসন্দেহে ২০২৩ সালে অনেক ভালোর দেখা দেশটা পেয়েছে, অনেক অর্জনেরও, কিন্তু দেখা পেয়েছে অনেক মন্দেরও। এই মন্দের হিস্যাটা ভারী হতে শুরু করেছে বছরের মাঝামাঝিতে এসে। এর প্রধান কারণ এই গায়ে গায়ে লেগে থাকা জনপদের মানুষগুলোর শক্তিশালী, শিক্ষিত, মোটামুটি সচ্ছল একটি অংশ নিজেদের মধ্যে তৈরি দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস থেকে হানাহানির দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অথচ একেবারে পৃথক একটা ছবি আমরা আঁকতে পারতাম, যাতে বিশ্ববাহিত মন্দ বাদে বাকি সব মন্দের জায়গায় আমরা ভালোর পতাকা তুলে দিতে পারতাম। ২০২৪ সালের শুরুতে একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে সারা দেশে একটা উৎসব চলতে পারত, অথচ উৎসবের পরিবেশটা এখন নেই।

আমরা জানি, সবচেয়ে ভালো নির্বাচনেও লাশ পড়ে, শত্রুতার পাত্র বিষে পূর্ণ হয়। কিন্তু সেগুলো ঘটে বিচ্ছিন্নভাবে, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা’গুলোতে। বরং দেশজুড়ে যা থাকত, তা একটা নিরুদ্বেগ সময়, নির্বাচনী উত্তেজনা, ঘড়ির কাঁটাকে অস্বীকার করে তুমুলভাবে মানুষের জেগে থাকা।

নতুন বছরের আশা: সভ্যতা কেন প্রয়োজন, ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি কেন প্রয়োজন—এসব যেন সবাই বুঝতে পারে, পশ্চিমা বিশ্বসহ সংঘাতপূর্ণ সব দেশ বোঝে এবং একটা কিছু করে, যাতে ফিলিস্তিন আর ইউক্রেনের, সিরিয়া আর আফ্রিকার সংঘাতপীড়িত দেশগুলোর, বিশ্বের সব স্থানের বিপন্ন শিশুরা যেন সহিংসতা থেকে মুক্তি পায়। আমরাও যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই আমাদের দেশের শিশুরাও যাতে আর কষ্ট না পায়, তা নিশ্চিত করতে।

যুদ্ধ-সহিংসতায় কাটা এ বছরের শেষ কটি মাস কেন জানি গাজার হারিয়ে যাওয়া শিশুরা অনেকের মতো আমাকেও দখল করে রেখেছে। তারা আমাদের বাধ্য করেছে সব শিশুকে নিয়ে ভাবতে। আমিও ভাবছি। ভেবে কষ্ট পাচ্ছি, আমাদের দেশের শিশুরাও তেমন ভালো নেই।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, প্রতিটি শহরে ছড়ানো–ছিটানো বস্তিগুলোতে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে, স্কুলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে না পেরে বাসাবাড়িতে কাজ নেওয়া এবং পথেঘাটে ভাসমান শিশুদের জীবন বলতে যা আছে, তা প্রতিদিন সংগ্রাম করে টিকে থাকা।

তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে হানাহানির কারণে পরিবারবিচ্ছিন্ন বাবাদের সন্তানেরা। আগামী বছরটা তারা কীভাবে কল্পনা করবে? নতুন বছরটা তাদের কাছে কেন অধরা থাকবে?

আমি দেখেছি, একসময় পরিবারের দুঃসময়ে প্রতিবেশীরা পাশে দাঁড়াত, সমবেদনা জানাত, এটা–ওটা দিয়ে সাহায্য করত। এখন বিশেষ করে শহরগুলোতে তা চোখে পড়ে না।

সবাই মিলে সমষ্টিগতভাবে কিছু করার, ভাবার অভ্যাসটা আমরা বহুকাল হয় হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমরা দুই পরিবারের ভেতর কোনো সমস্যা হলেও আর গুরুজনদের নিয়ে নিষ্পত্তি খোঁজার চেষ্টা করি না, তরুণ তুর্কিদের হাতে তলোয়ার তুলে দিয়ে বরং এসপার-ওসপারের দিকে যাই।

পরিবারে যা হয়, সমাজে তা-ই হয়, রাষ্ট্রেও। অথবা শুরুটা হয় সেই সর্ববৃহৎ পরিসরে, শেষটা পরিবারে অথবা ব্যক্তিতে। পরিবার হয়তো বড় ছবি দেখে শেখে। বড় ছবিটা তাই প্রথমে ঠিক করতে হবে। সেটি হোক আগামী বছরের একটা বড় করণীয়। তারপর ছোট ছবিগুলো। ছবিগুলোর অন্তরে থাকে ব্যক্তিমানুষ। সেই মানুষকে ঠিক করবে শিক্ষা আর সংস্কৃতি, যা বড় ছবিটা ঠিক হলে জীবনের ও কর্মের, দিনযাপনের, সব মানবিক সম্পর্কের, সমাজের গতিশীলতার আর বর্তমান-ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেবে, নান্দনিকতা আর মূল্যবোধের যুগল কাঠামোয় ব্যক্তি থেকে নিয়ে দেশটাকে স্থাপন করবে।

বড় ছবিতে থাকে অর্থনীতি, যার ঈশান কোণে জমা মেঘ ক্রমে কালো হচ্ছে; বড় ছবিতে থাকে মানুষের সমবায়ী চেষ্টায় যা যা গড়ে ওঠে, অর্থবহ ও সক্রিয় হয়, তা—যেমন কৃষি, যোগাযোগ, হরেক রকমের সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, কোর্ট-কাছারি। এসব ক্ষেত্রে এখন যা ঘটে, তা নিয়ে আমরা নিরুদ্বেগ থাকতে পারি না। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হলেও কেউ গা করে না। অথচ টাকা পাচার পরিব্যাপ্ত দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়ামাত্র। যাঁরা আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরান, সেই শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি না দিতে কোটিপতি মালিকদের কত যে যুক্তি আর টালবাহানা। বলা যায়, জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিস্তর মেরামতি প্রয়োজন। কিন্তু মেরামতি যাঁরা করবেন, তাঁদের থাকতে হবে একাগ্রতা, নিষ্ঠা, স্বচ্ছতা আর মানুষের কাছে জবাবদিহির একটা চর্চা। এগুলো না থাকলে মেরামতিটা কোনো কাজে আসে না। তবে ব্যক্তি সক্রিয় না হয়ে শুধু রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্বটা ছেড়ে দিলে চলবে না। ব্যক্তিমানুষেরা যদি ভালোর শপথ নেন, তাঁদের সম্মিলিত উদ্যমে রাষ্ট্রও সক্রিয় না হয়ে পারবে না।

আমাদের ভেতরের আশাবাদী কণ্ঠ তারপরও দাবি তোলে, সামনের বছর থেকে সবার প্রত্যয়ের যোগফলে মেরামতিটা শুরু হোক।

২.

নতুন বছর নিয়ে অনেক আয়োজন, অনুষ্ঠান হয়, মিডিয়ায় হইচই চলে। শহরগুলোতে উৎসব হয়। আমার পাড়ার বাড়ির ছাদগুলোতে উজ্জ্বল বাতি জ্বলে, নৃত্য-গান হয়। রাত ১২টা থেকে আতশবাজি পোড়ে, হাউই ওড়ে। কিন্তু বিশাল বাংলায় খ্রিষ্টীয় নতুন বছর আসে নিঃশব্দে। শুধু যাঁদের দৈনন্দিন লেনদেনের সঙ্গে পঞ্জিকা ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আছে, তাঁরা জানেন একটা বছর যাচ্ছে, আরেকটা আসছে। নতুন বছরটা যে একটা নতুন কিছু, যাঁদের হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন আছে, তাঁরা জানেন।

তারপরও নতুন বছরটার একটা প্রতীকী তাৎপর্য আছে, যা ওই ‘নতুনের কেতন’ ওড়ানোর মতো নতুন-পুরোনো, ভালো-মন্দ, শুভ-অশুভর দ্বন্দ্বে আর দ্বিত্বতায় নিহিত। মানুষ আশা করে, নতুন বছরে শুভ ও মঙ্গলের জয় হবে। সেই আশাই এখন করতে হবে। আমাদের রাজনীতি একটা অমানিশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, নির্বাচন তাকে আরও সংকটময় করবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, সংঘাত যেমন মেটে, সংকটও তেমনি কাটে। দলগুলো যদি দেশের দিকে তাকিয়ে খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসে, সংকট কাটবেই। অর্থনীতির সংকট কাটাতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন দুর্নীতির লাগাম টেনে তার গতি স্তব্ধ করে দেওয়া। প্রশাসন, পুলিশ, আইন–আদালতকে জনবান্ধব করতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা—এ রকম অনেক ছোট–বড় ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। মেরামতির তালিকাটা অনেক দীর্ঘ, তবে স্কুলশিক্ষার্থীদের তা জানা। রাষ্ট্রের মেরামতির দাবি তাদের থেকেই প্রথম উঠেছিল, তারাই যেহেতু রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। তাদের ও তাদের পরিবারগুলোকে আস্থায় নিয়ে মেরামতির কাজটা শুরু করলে সুফল পেতে দেরি হবে না।

আমরা আরও যা চাইব, নিজেদের ভেতর হানাহানির আর সহিংসতা যেন বন্ধ হয়। এটি অসভ্যতা। যেভাবেই তাকে বর্ণনা করা হোক, মানুষকে অধিকারবঞ্চিত করা, কষ্ট দেওয়া, তাদের আঘাত করা সভ্যতা নয়। যে দেশ মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, তার তো ক্ষুদ্রতার চর্চা শোভা পায় না।

নতুন বছরের আশা: সভ্যতা কেন প্রয়োজন, ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি কেন প্রয়োজন—এসব যেন সবাই বুঝতে পারে, পশ্চিমা বিশ্বসহ সংঘাতপূর্ণ সব দেশ বোঝে এবং একটা কিছু করে, যাতে ফিলিস্তিন আর ইউক্রেনের, সিরিয়া আর আফ্রিকার সংঘাতপীড়িত দেশগুলোর, বিশ্বের সব স্থানের বিপন্ন শিশুরা যেন সহিংসতা থেকে মুক্তি পায়। আমরাও যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই আমাদের দেশের শিশুরাও যাতে আর কষ্ট না পায়, তা নিশ্চিত করতে।

তারা যেন তাদের হাসি–আনন্দের শিশুকালটা ফিরে পায়। সেই শিশুকাল যেন সারা বছর নিরাপদ থাকে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষাবিদ ও কথাশিল্পী