সর্বজনীন পেনশনের সুবিধা কীভাবে সবাই পেতে পারেন

প্রবাসী, দেশে প্রচলিত পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোটি কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সব নাগরিকের জন্য সমান সুবিধার কথা বিবেচনা করতে হবে। সর্বজনীন পেনশনের সর্বজনীনতা কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়ে লিখেছেন শহীদুল জাহীদ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করেছে এবং ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি তা রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে আইনে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হয়েছে এবং এ কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।

সময়ে সময়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি জাতীয় পত্রপত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করলেও পেনশন স্কিমগুলোতে সর্বজনের অংশগ্রহণের বিষয়টি নানা মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সর্বজনীন পেনশন দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য সামাজিক সুরক্ষাবলয় হিসেবে কাজ করতে পারে—সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনের প্রারম্ভিকতায় যৌক্তিকতা হিসেবে এরূপ ধারণার কথা বলা হয়েছে।

সত্যিকার অর্থে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন প্রায় ৭৩ বছর হয়েছে। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার এ দেশে বর্তমানে তথাকথিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত লভ্যাংশ পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে।

অর্থশাস্ত্রে ১৬ থেকে শুরু করে ৬৪ বছর পর্যন্ত জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বলা হয়। বর্তমানে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি। বয়স্ক নির্ভরশীল জনসংখ্যা শতকরা ৭ ভাগের মতো হলেও ২০৫০ সাল নাগাদ এ হার শতকরা ২৫ ভাগে ছাড়িয়ে যাবে।

সে অর্থে বেশির ভাগ জনসংখ্যা বর্তমানে কোনো না কোনো কর্মসংস্থানে নিয়োজিত থাকায় দেশের জাতীয় উৎপাদন তথা জিডিপিতে তাদের অবদান অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি। জাতীয় অর্থনীতিতে দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার এরূপ উল্লেখযোগ্য অবদানকে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলা হয়।

‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কোনো দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত হলেও, সেটা প্রাপ্তির পরের ধাপে অর্থনীতিতে সংকোচনও আসতে পারে। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে বয়স্ক জনসংখ্যার পরিমাণ মোট জনসংখ্যার তুলনায় বেড়ে যায় এবং তারা নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

এ রকম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা এবং সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দেয়। রাষ্ট্র তাদের জন্য বিশেষ আর্থিক সুবিধা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ এবং বিনিয়োগ করে থাকে। আধুনিক অর্থনীতির একটি শাখা হিসেবে যা ‘ইকোনমিকস অব এজিং’ বা ‘প্রবীণদের জন্য অর্থনীতি’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

উন্নত বিশ্বে বিশেষত জাপান, জার্মানি, কানাডা, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক। এসব দেশে ‘প্রবীণদের অর্থনীতি’ খুবই প্রয়োজনীয় আলোচ্য বিষয়। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বিনোদন, যাতায়াত, খাদ্যনিরাপত্তা, বাসস্থান, ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবা এবং তার প্রয়োগ খুবই গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। সেসব দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে মানুষের পরিবর্তে রোবট ও রোবটিকসের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। এসবের জোগানের জন্যই উন্নত বিশ্বের ওই সব রাষ্ট্রকে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে।

বাংলাদেশেও সরকার অদূরভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য বয়স্ক এবং নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার কথা বলে সর্বজনীন পেনশন আইন করেছে। সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ দেশের ১০ কোটি মানুষকে পেনশন স্কিমের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ ‘প্রবাস’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’ এবং ‘সমতা’ শিরোনামে চারটি স্কিম বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময় ২০২৪ সালে আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পেনশন কর্তৃপক্ষ ‘প্রত্যয়’ নামে আরেকটি স্কিম ঘোষণা দেয়। সরকার সর্বজনীন পেনশনের আওতায় পাঁচটি স্কিম বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রবাসী, দেশে প্রচলিত পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা, আধা সরকারি, স্ব ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোটি কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সব নাগরিকের জন্য সমান সুবিধার কথা বিবেচনা করতে হবে। সরকার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সর্বজনীন পেনশনের সর্বজনীনতা সফল হতে পারে।

সর্বজনীন পেনশনের এসব স্কিমে খুব বেশি আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে—এমনটা বলা যাবে না। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ১৬ হাজার ৬০০ জন নিবন্ধন করেছেন এবং প্রায় ১৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়েছে। পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী তারা ১১ কোটির কিছু বেশি টাকা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে।

সর্বজনীন পেনশনের বৈশিষ্ট্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী যেকোনো নাগরিক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। অংশগ্রহণকারী নাগরিক তাঁর বয়স সর্বোচ্চ ৬০ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সুবিধাজনক স্কিমে নির্ধারিত হারে কিস্তির চাঁদা প্রদান সাপেক্ষে আজীবন মাসিক পেনশন সুবিধা পাবেন। ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক নাগরিক ন্যূনতম ১০ বছর নির্ধারিত কিস্তি পরিশোধের মাধ্যমে আজীবন পেনশন পাবেন। অংশগ্রহণকারী কোনো নাগরিক ১০ বছরের কম চাঁদা প্রদান করলে বা চাঁদা প্রদানে অপারগ হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে, তিনি বা তাঁর নমিনি মাসিক পেনশন পাবেন না। সে ক্ষেত্রে জমাকৃত টাকা সুদে-আসলে এককালীন ফেরত পাবেন।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নমিনির সুবিধা স্পষ্ট করা হয়েছে। মূল পেনশনার আজীবন মাসিক পেনশন পেলেও তাঁর বয়স জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ৭৫ পূর্ণ হওয়ামাত্রই তাঁর নমিনির নাম কর্তন হয়ে যাবে। পেনশনের চাঁদা প্রদানের বিভিন্ন হার এবং সময়ের সঙ্গে মিল রেখে ওই আইন ও নীতিমালায় ভবিষ্যতে মাসিক পেনশন কত হতে পারে, তারও সুস্পষ্ট তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশন বাস্তবায়নে জটিলতাগুলো কী? সর্বজনীন পেনশনের বৈশ্বিক উদাহরণ কেমন? এ দেশে সর্বজনীন পেনশনের ব্যাপ্তি বাড়ানোর জন্য আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, সর্বজনীন পেনশনের ধারণা মোটেই নতুন কিছু নয়। জাপান, নিউজিল্যান্ড, কানাডার মতো উন্নত দেশ তো বটেই, নিকট প্রাচ্যের থাইল্যান্ডও এটা চালু করেছে। দেশটি ২০০১ সালে এরূপ স্কিমের প্রচলন করে এবং ২০১২ সাল নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর ৯৫ ভাগ এর আওতাভুক্ত হয়। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সফলতার কারণগুলো উঠে আসে।

উল্লেখযোগ্য কারণগুলো ছিল, সর্বজনীন কভারেজ, পর্যাপ্ত ভবিষ্যৎ সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা, জমাকৃত তহবিলের ধারাবাহিকতা এবং সুরক্ষা, জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে পেনশনের সুবিধার সমন্বয়, সমতা এবং অগ্রসরতার সুযোগ, অন্তর্ভুক্তিমূলক মানসিকতা, সময়ে সময়ে এসব স্কিমের রিভিউয়ের ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষার পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনের নিশ্চয়তা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ইত্যাদি। এসব নানাবিধ কারণে বার্ধক্যে মানুষের দারিদ্র্যের হার, দারিদ্র্যের প্রকট, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, সামাজিক নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হয় এবং সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, এটি আইন করে বাধ্যতামূলক করা বেশ কঠিন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো এবং প্রথা অনুযায়ী এ দেশের মানুষ হয় নিজে অথবা সামাজিকভাবে নিজেদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করে থাকে। এ দেশের সমাজ, অর্থনীতি, জীবন-জীবিকার প্রকারভেদ, ধর্মীয় রীতিনীতি, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, আয়বৈষম্য, স্বল্প আয়, যৌথ পরিবার কাঠামো ইত্যাদি কারণে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন খুব বেশি। এসব কারণে কারও ব্যক্তিগত সমস্যায় সেই পরিবার, সমাজ বা প্রতিষ্ঠান সামগ্রিকভাবে অংশগ্রহণ করে এবং সমস্যা থেকে উত্তরণে সহায়তা করে।

প্রচলিত সমাজব্যবস্থার এরূপ নানাবিধ কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এ দেশের মানুষের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থাপনায় খুব বেশি অংশগ্রহণ দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, এ দেশে মানুষের ব্যাংকিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণের হার দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। নিকট অতীতে মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে ব্যাংকে হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কৃষকদের জন্য, যেখানে অংশগ্রহণের হার আশানুরূপ ছিল না। করোনার সময় প্রণোদনার টাকা বিতরণেও প্রথাগত ঝুঁকি ও সমস্যা দেখা যায়। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা ইত্যাদি কর্মসূচি চালু থাকলেও তা জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্ট নয়।

সর্বজনীন পেনশনের মাধ্যমে মূলত বার্ধক্যে তথা নির্ভরশীলতার সময়ে অংশগ্রহণকারীদের সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আপাত আর্থিক সুবিধা, যা মাসিক পেনশন হিসেবে ভবিষ্যতে দেওয়া হবে তার উৎকৃষ্ট ব্যবহারের কথা এখনই বিবেচনা করতে হবে। ধরে নেওয়া যাক, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করলেন। এসব কর্মক্ষম মানুষ তাদের বর্তমান আয়ের একটা অংশ পেনশনের কিস্তি হিসাবে দেবেন এবং বৃদ্ধ বয়সে সরকার কর্তৃক ঘোষিত মাসিক পেনশন পাবেন। কিন্তু ভবিষ্যতে তাঁরা টাকা দিয়ে কী করবেন, ওই সময়ে তাঁদের চাহিদা কী হবে, জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ের সঙ্গে তখনকার পেনশন সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কি না, এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই খুঁজতে হবে।

বার্ধক্যে মানুষ টাকাপয়সার চেয়েও বেশি নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা চান। তাঁরা চাইবেন উন্নত স্বাস্থ্যসেবা। নির্মল বিনোদনের জন্য যথেষ্ট আয়োজন, যেমন পার্ক ও হাঁটার রাস্তা। মনে রাখতে হবে, আজ যাঁরা কষ্ট করে চাঁদা দেবেন ভবিষ্যতে তাঁরা যথার্থ সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা না পেলে, বেশির ভাগ মানুষ সর্বজনীন পেনশনে উদ্বুদ্ধ হবেন না।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নে কিছু কিছু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশ্ন উঠেছে। সর্বজনীন পেনশন-সংক্রান্ত ২০২৪ সালের প্রজ্ঞাপনে স্ব এবং স্বায়ত্তশাসিত কোম্পানি, করপোরেশন, কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে নিয়োজিত জনবলের জন্য সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অর্থে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের থেকে আলাদা নিয়মে পেনশন পাবেন।

বর্তমানে প্রচলিত পেনশন নীতিমালায় এবং নতুন প্রচলিত সর্বজনীন পেনশন অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা তাদের ভবিষ্যৎ সুযোগ-সুবিধা এবং মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি চাকরিরত কোনো ব্যক্তি ন্যূনতম ২৫ বছর চাকরি করলে পূর্ণ পেনশনের যোগ্য হন। ধরা যাক, কারও সর্বশেষ আহরিত মূল বেতন ৭০ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে তিনি মূল বেতনের ৪৫%-এর প্রতি ১ টাকার জন্য ২৩০ টাকা হারে প্রায় ৭২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা এককালীন পেনশন পাবেন।

বিদ্যমান হিসাবে তিনি প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ টাকা মাসিক পেনশন, মেডিকেল ভাতা, বাৎসরিক বোনাস, উৎসব ভাতা ইত্যাদি পাবেন। তাঁর বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হবে, তিনি অবসর প্রস্তুতিকালীন বেতন, ছুটির নগদায়ন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত টাকা সুদে-আসলে পেয়ে থাকেন। বিদ্যমান নিয়মে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি অবসরকালীন আজীবন পেনশন পান এবং তাঁর নমিনিও আজীবন মাসিক পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন।

নতুন সর্বজনীন পেনশন নীতিমালায় পেনশনার কোনো এককালীন নগদ টাকার সুবিধা পাবেন না। অবসর গ্রহণকালীন সময় তথা ৬০ বছর বয়স থেকে আজীবন তিনি মাসিক পেনশন পাবেন। ক্ষেত্রবিশেষে ২৫ বছর ধরে (গড়ে) প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা (অর্ধেক ব্যক্তির বেতন থেকে এবং অর্ধেক সরকার বা প্রতিষ্ঠান দেবে) পেনশনের কিস্তি পরিশোধ সাপেক্ষে মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আজীবন পেনশন পাবেন। কিন্তু পেনশনারের নমিনি জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পেনশনারের বয়স ৭৫ হওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন।

উদাহরণস্বরূপ, নতুন নিয়মে কোন পেনশনার ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর জীবিত স্ত্রী বা নমিনি তাঁর বয়স যা-ই হোক না কেন, সর্বোচ্চ ৫ বছর পেনশন পাবেন। প্রচলিত এবং প্রস্তাবিত পেনশন নীতিমালায় ভবিষ্যৎ পেনশন বা আর্থিক সুবিধা কম না বেশি—এরূপ বিতর্কে না জড়িয়ে সবার জন্যই একই নীতিমালা করা দরকার ছিল। তাহলে বিতর্ক এড়ানো এবং সর্বজনীন পেনশনের বাস্তবায়নে সামষ্টিক কাভারেজ বাড়ানো যেত।

সর্বজনীন পেনশন বাস্তবায়নের জন্য ভবিষ্যতের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে তো বটেই, বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানেই ন্যূনতম পেনশন সুবিধা নেই।

প্রবাসী, দেশে প্রচলিত পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা, আধা সরকারি, স্ব ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোটি কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে সব নাগরিকের জন্য সমান সুবিধার কথা বিবেচনা করতে হবে। সরকার ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা কর্তৃপক্ষকে উদার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সর্বজনীন পেনশনের সর্বজনীনতা সফল হতে পারে।

  • শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক