জনগণের প্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঁচ বছর পরপর সরকার ক্ষমতায় আসে। নানা ভুলত্রুটি, ভালো-মন্দ এবং চাওয়া–পাওয়ার হিসাবে দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সাধারণ জনগণের ব্যক্তিগত কল্যাণ-অকল্যাণের প্রশ্নটি সামনে আসে। এ কথা আমরা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির চাওয়ার-পাওয়ার হিসাব যথাযথভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের পরিবর্তে ব্যক্তি অকল্যাণের প্রশ্ন যখন সামনে আসে, সেটি কখনোই কাম্য হতে পারে না।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের ব্যক্তিপর্যায়ে অকল্যাণের পরিবেশ তৈরি হয়। এমনও অনেক ঘটনা আছে যে সাধারণ মানুষের ওপর কিছু কিছু অন্যায় আচরণ বাধ্যতামূলক চেপে যায়। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনের গাফিলতি কিংবা উদাসীনতায় এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আমরা জানি, সরকারি চাকরিজীবীদের স্বামী-স্ত্রী একই কর্মস্থলে অথবা নিকটবর্তী কর্মস্থলে চাকরি করার প্রতিষ্ঠিত বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কয়েক দফা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এমনকি সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাগিদ দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে কয়েকবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ ছাড়া উচ্চ আদালতসহ প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও এই বিধান যথাযথভাবে সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় না। আমার জানামতে, সারা দেশে বহু নজির রয়েছে, যেগুলোতে উল্লিখিত বিধান অনুসরণ করা হচ্ছে না। তবে কেন হচ্ছে না, এ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২০১০ সাল থেকে কর্মরত। ২০১৬ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি বদলির আদেশ জারি করলে ওই শিক্ষকের স্বামীর কর্মস্থলে পদায়নের নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রশাসনকে বদলির আদেশটি অবিলম্বে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট স্থানে শূন্যপদ না থাকার অজুহাতে ছয় বছর ধরে স্থানীয় প্রাথমিক প্রশাসন তাকে পদায়ন করেনি। বারবার তাদের কাছে পদায়নের নিমিত্তে আবেদন জানানো হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
অথচ শিক্ষকদের বিপক্ষে যায়, এমন কোনো আদেশ মন্ত্রণালয় থেকে জারি হলে স্থানীয় প্রশাসন সেটি বাস্তবায়নের জন্য জোর তৎপরতা শুরু করে দেয়। এ ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠিত চিন্তা দাঁড়িয়ে গেছে যে স্থানীয় প্রাথমিক প্রশাসনকে অর্থনৈতিক উপঢৌকন দিয়ে ম্যানেজ করা যায়নি কিংবা স্থানীয় রাজনীতিবিদ দ্বারা যথাযথ তদবির করা হয়নি। এ জন্যই হয়তো উল্লিখিত বদলি আদেশটি তারা বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, একটি উপজেলায় ছয় বছর ধরে একটিও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য হয়নি নাকি স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে তথাকথিত প্রক্রিয়ায় ম্যানেজ করা যায়নি।
একজন সাধারণ নাগরিক তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পক্ষে স্থানীয় প্রাথমিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তির সামনে গিয়ে কথা বলতে পারাটা খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ, তারা বিবেচনা করে, তিনি নিজে একজন ‘লর্ড’ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক একজন নিতান্তই তার অধীন কর্মচারী।
এ জন্য বদলি আদেশটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমার জানামতে, বছরের পর বছর অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যাঁরা স্বামী-স্ত্রী একই কর্মস্থলে চাকরি করতে পারছেন না। এমনকি আমার কাছে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে, গত পাঁচ বছরে বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যাঁরা বদলি হতে না পেরে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তা ছাড়া বছর বছর নতুন নতুন নীতিমালা করে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি প্রক্রিয়াকে জটিল থেকে জটিলতর করা হয়েছে। স্বামী বা স্ত্রী সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বদলির সুযোগ পাবেন বলে সুস্পষ্ট বিধান হওয়া সত্ত্বেও উল্লিখিত সহকারী শিক্ষকের বদলি আদেশটি যথাযথভাবে কেন আমলে নেওয়া হলো না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। উল্লেখ্য, আমার জানামতে, একই আদেশে অন্য সহকারী শিক্ষকদের বদলি আদেশ বাস্তবায়ন করে পদায়ন করা হয়েছে।
উল্লিখিত সহকারী শিক্ষক ২০১৫ সালের মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে সংযুক্তিতে রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন। এমন আরও অনেকেই সারা দেশে স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থলে মন্ত্রণালয়ের আদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিরত ছিলেন। কিন্তু গত ৮ ডিসেম্বর ২০২২ এক আদেশবলে সব সংযুক্তরত শিক্ষককে তাদের মূল কর্মস্থলে ফেরত পাঠানো হয়। অথচ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর একটি সার্চ কমিটি করে সংশ্লিষ্টরা কে কোথায়, কেন এবং কোন উদ্দেশে সংযুক্তি নিয়ে কর্মরত আছেন, সেগুলোর খবর নিয়ে যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করতে পারত। বরং তা না করে একযোগে বাতিল করে ব্যক্তিপর্যায়ে একধরনের হয়রানি কিংবা অকল্যাণের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
আমরা সুশাসন বলতে সেসব চিন্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি, সেগুলোর অন্যতম হিসেবে এই প্রক্রিয়াকে ন্যায্য হিসেবে বিবেচনা করা যেত। ছয় বছর ধরে একটি বদলি আদেশ বাস্তবায়ন করতে অলসতা কিংবা গড়িমসি চলে অথচ এক আদেশে স্বামী কিংবা স্ত্রীর কর্মস্থলে চাকরিরতদের হঠাৎ করে মূল কর্মস্থলে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি কতটুকু ন্যায্য সেই প্রশ্নটি সবার সামনে উত্থাপন করছি।
একজন সাধারণ নাগরিক তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পক্ষে স্থানীয় প্রাথমিক প্রশাসনের কর্তাব্যক্তির সামনে গিয়ে কথা বলতে পারাটা খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ, তারা বিবেচনা করে, তিনি নিজে একজন ‘লর্ড’ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক একজন নিতান্তই তার অধীন কর্মচারী। ওই সব কর্তাব্যক্তি কোনো কোনো সময় নিজেকে প্রভু মনে করেন। তাঁরা তাঁদের অধীন সহকারী শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনাকেও সঠিকভাবে সাড়া দিতে বিব্রত হন।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় লক্ষ করা যায়, অর্থনৈতিক উৎকোচ বিনিময়ের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের ন্যায্য দাবি বা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তথাকথিত প্রভুদের পিছে পিছে ঘুরে জুতা ক্ষয় করে ফেলতে হয়।
অথচ যে কাজটি একজন সরকারি কর্মকর্তা নিজে থেকেই ন্যায্যতার মাপকাঠিতে করতে পারেন, সে কাজটিও বাস্তবায়ন হওয়ার জন্য প্রতিদিন তাদের পেছনে ধরনা দিতে হয় কিংবা স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক তদবির করতে হয়।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট তদবির না করা পর্যন্ত ন্যায্য কাজটিও অন্যায্যের তালিকায় পড়ে থাকে। এ বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাই থাকে না। অনেক সরকারি দপ্তরে কাজ করতে গেলে সাধারণদের হয়রানি হতে হয়, এ বিষয়ে সর্বজনবিদিত একটি ধারণা রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে যিনি প্রভাবশালী, তার কাজটি খুব সহজেই হয়। প্রকৃত অর্থেই একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এমন অন্যায্য প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এসে সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণের দিকে অধিক মনোযোগী হওয়া আবশ্যক।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।