মতামত

সাজা এড়াতে ব্ল্যাকমেলের আশ্রয় নিচ্ছেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্পে
ছবি : রয়টার্স

চলতি মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালিয়ে অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় নথি ও ফাইল উদ্ধার সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর চাটুকারেরা এলোমেলো ও ফাঁকিতে ভরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ট্রাম্পকে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়ই, তাহলে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সরকারকে ব্ল্যাকমেল করাই হবে তাঁর সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র।

গুপ্তচরবৃত্তি আইন ও অন্যান্য আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের উল্লেখ করা হয়েছে এমন একটি ওয়ারেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডের অনুমতি ও একজন ফেডারেল জজের অনুমোদন পেয়ে নজিরবিহীনভাবে একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালানো হয়।

কয়েক মাস ধরে মার্কিন বিচার বিভাগ ট্রাম্পের আইনি সহায়তা দলের সঙ্গে সব নথি সংগ্রহ করতে কাজ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এক গাদা মিথ্যা ছাড়া তারা কিছু পায়নি।

ওয়ারেন্টের যথেষ্ট আইনি ন্যায্যতা আছে এবং সেগুলো থেকে প্রতীয়মান হয়, ট্রাম্প জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করার অভিযুক্ত আসামি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এটি বিভিন্ন ফেডারেল, রাজ্য এবং স্থানীয় তদন্তে ইতিমধ্যে বেরিয়ে আসা সম্ভাব্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি অভিযোগের দীর্ঘ তালিকার একেবারে শীর্ষে থাকবে।

আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কে ট্রাম্পের মূর্খতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাঁর অবমাননাকর আচরণ প্রকাশিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের শ্রেণিবদ্ধ অতি গোপনীয় নথি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা তাঁর উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি আবারও নিশ্চিত করেছে, সংস্থাগুলোর সততা এবং সেগুলো পরিচালনা করে এমন আইন ও নিয়মের প্রতি ঘৃণা ছাড়া ট্রাম্পের আর কিছুই নেই। এ থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প ২০২৪ সালে আবার প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হলে তিনি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়াবেন।

ট্রাম্পের দাবি, এই নথিগুলো তাঁর সম্পত্তি। কিন্তু আসলে চুরি করা নথিগুলো তাঁর সম্পত্তি নয়। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেনশিয়াল রেকর্ডস অ্যাক্ট পাস করার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের ওয়াটারগেট-পরবর্তী আইনকে শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করা হয়। এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ন্যাশনাল আর্কাইভসের কোনো নথিতে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের মালিকানা থাকবে না এবং হোয়াইট হাউসই হবে সব নথির হেফাজতকারী।

কীভাবে ট্রাম্প এই শ্রেণিবদ্ধ নথিগুলো ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তা এখন তদন্তকারীদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ট্রাম্পের অতীত আচরণ এবং ২০২৪ সালের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে মার-এ-লাগোতে এফবিআইয়ের পাওয়া নথির বিষয়ে সব আমেরিকানের খেয়াল রাখা উচিত। কারণ, এটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি ট্রাম্পের নির্লজ্জ অবহেলার বিষয়টি আরও নিশ্চিত করে।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, এফবিআই তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ১১টি বাক্স বোঝাই যে নথিপত্র পেয়েছে, তা তিনি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এবং সে কারণেই এসব নথি আর গোপনীয় বলে বিবেচিত হতে পারে না। কিন্তু তিনি তাঁর দাবির সমর্থনে কোনো ধরনের রেকর্ড দেখাতে পারেননি; এমনকি সে ধরনের কোনো রেকর্ড যদি তিনি দেখাতে পারতেনও, তাহলেও কিছু যেত আসত না।

এর কারণ হলো হোয়াইট হাউসের কোনো নথি, সে গোপনীয় হোক বা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষিত হোক—যেকোনো নথির অননুমোদিত অপসারণ অবৈধ। আর তা ছাড়া কোনো ক্ল্যাসিফায়েড বা গোপনীয় নথিকে ডিক্ল্যাসিফাই করা বা উন্মুক্ত ঘোষণা করার এখতিয়ার একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের নেই।

অতীতে হোয়াইট হাউসের কিংবা মন্ত্রিপরিষদ স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা জাতীয় নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের তাঁর জন্য খেসারত দিতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে জন এম ডিউচ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করার পর, কর্মকর্তারা আবিষ্কার করেন, তিনি দায়িত্ব পালনকালে নিয়মিতভাবে একটি অরক্ষিত ব্যক্তিগত কম্পিউটারে অতি গোপনীয় গোয়েন্দা নথি জমা করেছেন।

এ ঘটনার পর ডিউচ তাঁর নিরাপত্তা ছাড়পত্র হারান এবং শেষ পর্যন্ত শ্রেণিবদ্ধ তথ্যের ভুল ব্যবস্থাপনার জন্য দোষ স্বীকার করতে সম্মত হন (অবশ্য ফেডারেল প্রসিকিউটররা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করার আগেই প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন)।

২০০৫ সালে ক্লিনটনের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্যান্ডি বার্গারকে জাতীয় আর্কাইভস থেকে গোপন নথি সরানোর জন্য ৫০ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়েছিল এবং তিন বছরের জন্য তিনি তাঁর নিরাপত্তা ছাড়পত্র (সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স) হারিয়েছিলেন।

২০১৫ সালে আরেকজন সাবেক সিআইএ পরিচালক ডেভিড পেট্রাউসকে গুরুতর নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের জন্য ৪০ হাজার ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল এবং একই সঙ্গে দুই বছর তাঁকে নজরদারিতে রাখারও রায় দেওয়া হয়েছিল। পেট্রাউস তাঁর জীবনীকার ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে অতি গোপনীয় তথ্য (যা সাধারণ মানুষের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত) সংবলিত নোটবুক দেখার অনুমতি দেওয়ার জন্য তাঁর এই সাজা হয়েছিল।

কিন্তু পেট্রাউসের সেই মামলা এখন গোপন তথ্যের ভুল ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে ফেডারেল প্রসিকিউটরদের অসুবিধার মুখোমুখি হওয়ার আভাস দিচ্ছে। ওই সময় বিচার বিভাগ পেট্রাউসের কাছে একটি দর-কষাকষির প্রস্তাব করেছিল।

কারণ, বিচার বিভাগের এই ভয় ছিল যে পেট্রাউস খোলা আদালতে কী ফাঁস করে দেবেন—গোপন এজেন্টদের নাম, গোপন অভিযান এবং বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংবেদনশীল সম্পর্কসহ নানা কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। পেট্রাউস ও বার্গারের যে সাজা হওয়ার কথা ছিল, তা এসব সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের ভয়ে সে মাত্রায় সাজা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ঝুঁকি এড়াতে প্রসিকিউটররা কতটা সীমাবদ্ধ থাকবেন, তা এসব মামলায় দেখা গেছে।

নিশ্চিতভাবেই আদালতের বিচার বা ফৌজদারি অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এড়াতে ট্রাম্প একই কার্ড খেলবেন। তঁার অনিয়মিত, বেপরোয়া আচরণের ইতিহাস সে কথাই বলে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি সংবেদনশীল সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের কথা অর্থহীনভাবে প্রকাশ করা থেকে শুরু করে টুইটারে অতি গোপনীয় স্যাটেলাইট ছবি পোস্ট করা তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়কে তুলে ধরেছে।

কীভাবে ট্রাম্প এই শ্রেণিবদ্ধ নথিগুলো ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তা এখন তদন্তকারীদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ট্রাম্পের অতীত আচরণ এবং ২০২৪ সালের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে মার-এ-লাগোতে এফবিআইয়ের পাওয়া নথির বিষয়ে সব আমেরিকানের খেয়াল রাখা উচিত। কারণ, এটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি ট্রাম্পের নির্লজ্জ অবহেলার বিষয়টি আরও নিশ্চিত করে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

কেন্ট হ্যারিংটন সিআইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ও সিআইএর পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের সাবেক পরিচালক