আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উন্নতি হবে না, যদি...

অধিকার হরণের প্রতিবাদে তালেবান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আফগান নারীদের বিক্ষোভ
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অস্থিরতার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে এবং এর দায়ের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে পড়ে। যত দিন এই বিরাট অঞ্চল অশান্তিতে ডুবে থাকছে, তত দিন এখানে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব থাকবে।

আফগানিস্তানের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। পাকিস্তান-সমর্থিত তালেবান মিলিশিয়াদের হাতে দেশটিকে ছেড়ে আসার পর থেকে প্রায় ২২ মাস পার হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সেখানে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

আফগান জনগণের ওপর নৃশংসতা চালানো ও মধ্যযুগীয় নিয়মকানুন চালু করার পাশাপাশি সেখানে তালেবান কর্তৃপক্ষ নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং আল–কায়েদা ও অন্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে তাদের গভীর গাঁটছড়া তৈরি হয়েছে।

পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া একটি মূল্যায়ন রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তান এখন আল–কায়েদা ও আইএসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেইও। আফগানিস্তানের তালেবান শাসনের মন্ত্রিসভায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও মাদক পাচারকারী ব্যক্তিও রয়েছে। গত বছর আমেরিকান ড্রোন কাবুলে একটি সন্ত্রাসী আখড়ায় হামলা চালিয়ে জাতিসংঘের ঘোষিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী ও আল–কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরিকে হত্যা করা হয়।

এ ছাড়া আফগানিস্তান থেকে আইএস তাদের আন্তর্জাতিক তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে এবং আইএস ও তালেবানের জোট গঠন দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসার মাধ্যমে তারা যে শুধু তাদের স্থানীয় মিত্রদের অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে এসেছে তা-ই নয়, বরং তারা সেখানে শত শত কোটি ডলারের আধুনিক আমেরিকান সামরিক যন্ত্রপাতিও রেখে এসেছে। কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম ঘাঁটিও তারা তালেবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে।

পাকিস্তানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিও গভীরভাবে বিপথগামী হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারত্বের সুবাদে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং তাদের দুর্বৃত্ত সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সন্ত্রাসবাদকে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে।

সর্বশেষ বিক্ষোভ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও জনগণের সম্পর্কে নতুন করে চিড় ধরিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী এমনিতে পিছু হটছে না। সেখানে ফের জরুরি অবস্থা জারি করা হতে পারে অথবা সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। এই সংকট সেখানে গৃহযুদ্ধও বাঁধিয়ে দিতে পারে। এই মুহূর্তে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রস্থল এবং আফগানিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টির বিষয়ে দেশটি উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টিকে আমলে নিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল। পাকিস্তান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করা পর্যন্ত দেশটিকে হাতের নাগালে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন এসে এই নীতিকে সম্পূর্ণ উল্টে দেয়।

১৯৯০–এর দশকে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমকে হটিয়ে দিতে আইএসআই তালেবান গঠনে মদদ দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন গত বছর পাকিস্তানকে ঋণখেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে সহায়তা করেছে। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে দেওয়া এফ-১৬ জঙ্গি বিমান (পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হওয়ায় এই যুদ্ধবিমানের আলাদা মাত্রার গুরুত্ব রয়েছে) আধুনিকীকরণে ৪৫ কোটি ডলারের একটি চুক্তি করে।

এখন পাকিস্তান একটি গভীর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মুখে পড়েছে, যার মূলে আছে সামরিক-বেসামরিক শিবিরের দ্বন্দ্ব। দেশটির সামরিক গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। তারা ৩৩ বছর দেশটি শাসন করেছে। যখন তারা সরাসরি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ শাসন করেনি, তখন বেসামরিক সরকারকে নেপথ্য থেকে তারাই চালিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা কখনোই বেসামরিক সরকারের কাছে জবাবদিহি করেনি। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অনুগ্রহ বলয়ের বাইরে যাওয়ায় দু–দুজন প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গত ৭৫ বছরে এই প্রথমবারের মতো উৎখাত হওয়া প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে ইমরান খানের সমর্থকেরা সরাসরি সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ মাসের গোড়ায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করার পর পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। সামরিক স্থাপনায়ও তারা হামলা চালায়।

রাজনৈতিক সংকট উন্মোচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান দেউলিয়াত্বের একেবারে কানায় চলে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ঋণ পুনর্গঠন করে নতুন করে ঋণ না দেওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে তার মিত্রদেশগুলো স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিয়ে কোনোরকমে ভাসিয়ে রেখেছে।

সর্বশেষ বিক্ষোভ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও জনগণের সম্পর্কে নতুন করে চিড় ধরিয়েছে। তবে সেনাবাহিনী এমনিতে পিছু হটছে না। সেখানে ফের জরুরি অবস্থা জারি করা হতে পারে অথবা সেনা অভ্যুত্থান ঘটতে পারে। এই সংকট সেখানে গৃহযুদ্ধও বাঁধিয়ে দিতে পারে। এই মুহূর্তে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রস্থল এবং আফগানিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টির বিষয়ে দেশটি উসকানি দিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন না হলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উন্নতি হবে না এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বোচ একাডেমির একজন ফেলো