হামাস এককথায় অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছে। ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা করেছে। এত দিন ইসরায়েলকে দুর্ভেদ্য বলেই মনে হতো। এই বিশ্বাসকে একদম গুঁড়িয়ে দিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে নানা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে।
অত্যাধুনিক সামরিক বাহিনী, কার্যকর নজরদারিপ্রযুক্তি এবং চৌকষ ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে গাজা সীমান্ত অতিক্রম করে হামাসের শত শত যোদ্ধা। তাঁদের হামলায় নিহত হন নয় শতাধিক ইসরায়েলি। জিম্মি হিসেবে শতাধিক মানুষকে ধরেও নিয়ে গেছে হামাস। তাদের এ হামলায় সারা বিশ্ব হকচকিত ও বিহ্বল। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, এখনো অনেকেই ঠাওর করে উঠতে পারছেন না।
ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ভয়ে আরবের সুবিধাবাদী নেতারা কম্পমান থাকেন। সেই মোসাদ, শিন বেত এখন দিশা খুঁজে পাচ্ছে না ফিলিস্তিনের বেপরোয়া, সাহসী যোদ্ধাদের হামলার মুখে। বেপরোয়া ও অসম্ভব সাহসী না হলে প্যারাগ্লাইডিং করে উড়ে এসে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মুখের কথা নয়। গত শনিবার সকালে ফিলিস্তিনের বেপরোয়া যোদ্ধারা সেই কাজই করে দেখালেন।
যুদ্ধ ও ভালোবাসায় নাকি কোনো হিসাব–নিকাশ করতে নেই। স্থির লক্ষ্যে কার্যকর কৌশল নিয়ে সাহসের ওপর ভর করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। এরপর ভাগ্য সাহসীদের ইতিহাসের পাকা আসনের দিকে নিয়ে যায়। হয় প্রেমিকের আসন, না হয় দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা। ফিলিস্তিনিরা একই সঙ্গে প্রেমিক ও যোদ্ধা। মাতৃভূমির প্রতি অগাধ প্রেম তাঁদের দুর্দমনীয় যোদ্ধায় পরিণত করেছে। অসংখ্যবার হামলা করে ফিলিস্তিনিদের ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ইসরায়েল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই বারবার ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে ফিরে এসেছে ফিলিস্তিনিরা।
প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েল এই ধরনের ক্ষতি ও হামলার মুখে খুব বেশি পতিত হয়নি। ১৯৪৭, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩—৩টি যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৭৩–এর ৬ দিনের যুদ্ধের পর অধিকৃত সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি মিসর ও সিরিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এরপর ইসরায়েল এতটা ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন না। যদিও ইসরায়েলের পাল্টা হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা পাঁচ শ’র মতো, আহত দুই সহস্রাধিক। বিমান হামলা করে গাজায় অনেক ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৭৭ হাজার গাজাবাসী।
সব মিলিয়ে গাজা-ইসরায়েল অঞ্চল এখন অগ্নিগর্ভ। ইসরায়েল অজেয়, দুর্ভেদ্য—এই ধারণা আমূল বদলে গিয়ে আরবের রাজনীতিকে নতুন বাঁকের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এত দিন গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল বিশ্ব। কিন্তু এবার ভিন্ন দৃশ্যও দেখা গেল। ইসরায়েলিদের ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা; ইসরায়েলিদের জন্য এটা অকল্পনীয় ও অভাবনীয় দৃশ্য।
তবে হামলার ধরন ও পদ্ধতি দেখে বোঝাই যাচ্ছে হামাস সময় নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই হামলা করেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তিতে হামলা করে অনেক ইসরায়েলিকে ধরেও নিয়ে গেছে হামাস। ইসরায়েলের পাল্টা হামলা বন্ধের জন্যই হামাস এই পরিকল্পনা করে থাকতে পারে। হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারের জন্য চাপ থাকবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের ওপর। অপহৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা চাইবেন যেকোনো প্রকারেই যেন জিম্মিদের জীবিত উদ্ধার করা হয়।
কিন্তু জিম্মিদের নিয়ে হামাস দর-কষাকষি করবে। ইসরায়েল হামলার পরই বেশ হম্বিতম্বি শুরু করেছে। গাজা সীমান্তে ব্যাপক সেনাসমাবেশ করে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। এর আগেই দফায় দফায় গাজায় বিমান হামলা করেছে। আবার জিম্মিদের উদ্ধারের জন্য মিসরকে মধ্যস্থতা করার অনুরোধও করেছে। এর ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ইসরায়েল সামরিক অভিযানের পাশাপাশি জিম্মি উদ্ধারের আলোচনা করতে চাইবে। অপহৃত ব্যক্তিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। যে কারণে এক জায়গায় হামলা করলে অন্য জায়গায় অপহৃত ব্যক্তিদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এ ছাড়া জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলি কারাগারে আটক নেতাদের ছাড়িয়ে নিতে চাইবে হামাস। প্রথম দফার হামলায় পর্যুদস্ত ইসরায়েলের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে না। বড় ধরনের সামরিক অভিযান আরও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। স্থলযুদ্ধে ইসরায়েলের অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ১৯৮২ ও ২০০৬ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালাতে গিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছিল। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী জাহাজ রওনা দিয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়লে ইরান, সিরিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহসহ আরবের বিভিন্ন গ্রুপ সম্পৃক্ত হতে পারে। ইতিমধ্যেই লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ হামলা করেছে। হামলার পরপরই হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া সারা বিশ্বের মুসলমানদের এই যুদ্ধে শরিক হয়ে জেরুজালেমকে মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়াও পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। সেই জটিল অবস্থা ইসরায়েলের জন্য নেতিবাচক হতে পারে।
ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে ক্ষতির বিষয় হচ্ছে তাদের দুর্জেয় ভাবমূর্তি পুরোপুরি ধসে গেছে। ইউরোপ ও আরবের বিভিন্ন দেশে থেকে ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষজন এসে বসতি গড়েছেন গত ১০০ বছরে। ইসরায়েলের নাগরিকদের বেশির ভাগই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী নন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বসতি স্থাপনকারীরা নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন। একসময় ইউরোপে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁরা জায়নবাদী রাজনীতির খপ্পরে পড়ে ফিলিস্তিনে এসে জবরদখল করে বসতি গড়েছিলেন। ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমির ধারনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ফিলিস্তিনে এসে তাঁরা দেখলেন, এখানে দিনরাত বোমাবাজি ও গোলাগুলি হচ্ছে। লাখো ফিলিস্তিনির রক্তের হোলিতে স্নাত হয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র আজকের দানবীয় পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। কিন্তু যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ফিলিস্তিনকে অস্বীকার করে ইসরায়েলে স্থায়ীভাবে শান্তি আসবে না।
ঐতিহাসিক এই বাস্তবতার সঙ্গে সম্প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ইসরায়েলের নাগরিকদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। গত কয়েক বছরে ইসরায়েলে বড় ধরনের জনবিক্ষোভ হয়েছে। যে কারণে ইসরায়েলিদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ইসরায়েলি পর্তুগালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। হাজারো ইসরায়েলি নাগরিক ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অভিবাসন কার্যালয়ে ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত। অভিবাসন আবেদনের হার ১০ শতাংশ বেড়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে। এই অবস্থায় হামাসের হামলা ইসরায়েলি নাগরিকদের ভীতসন্ত্রস্ত করবে নতুন করে। হামলার পরপরই তেল আবিবের বেন গুরিয়ান বিমানবন্দরে উপচে পড়া ভিড় ছিল আতঙ্কিত মানুষজনের। ভীত নাগরিকদের ইসরায়েল ছাড়ার প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করবে হামাসের হামলা।
এই হামলা মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বরাজনীতিতে ভালো রকমেরই প্রভাব বিস্তার করবে। হামলার সমালোচনা করে যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইরানসহ বিভিন্ন দেশ এই হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে। তেহরান, ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা, কুয়েত সিটি, সানা, ইসলামাবাদে ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা উল্লাস করেছেন। তেহরানের ফিলিস্তিন চত্বরে বাজি ফোটানো হয়েছে রীতিমতো। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের সামনে ফিলিস্তিনের সমর্থকেরা মিছিল করেছেন। ইউরোপ–আমেরিকার ২০ শহরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চীন ও রাশিয়া সংকট সমাধানের জন্য ১৯৬৭ সালের সীমারেখার ভিত্তিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে। চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ইসরায়েলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হবে। এই যুদ্ধ থেকে রাশিয়া সরাসরি লাভবান হবে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি ইসরায়েলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। জেলেনস্কির ঘোষণা মুসলিম দেশগুলোতে ইউক্রেন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করবে। এর সুবিধা পাবে রাশিয়া।
সব থেকে বেশি বিপাকে পড়বে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাওয়া মুসলিম দেশগুলো। সম্প্রতি সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে বলে কথা উঠেছিল। হামাসের হামলা ও যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে এই দেশগুলোর পক্ষে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হবে না। তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া থমকে যাবে। কিন্তু এই দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষ থেকে চাপের মুখে পড়বে।
হামাসের এবারের হামলাকে নেহাত ফিলিস্তিন–ইসরায়েল যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এ হামলা শুধু প্যারাগ্লাইডিং করে প্রবেশ করেই হয়নি, হামাস ইসরায়েলের আলোচিত বিলিয়ন ডলার মূল্যের আয়রন ডোমকে কয়েক শ ডলার দামের রকেট দিয়ে পরাভূতও করেছে। চাইলেই হামাস আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে হামলা করতে পারত। কিন্তু হামাসকে আড়াল থেকে যারা সহায়তা করছে, তারা এই হামলার স্থানীয় চরিত্র বজায় রাখতে মনোযোগী ছিল। তাই হামাস অতি সাধারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে। কিন্তু হামলা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত ও লক্ষ্যভেদী। যে কারণে ইসরায়েল রীতিমতো তছনছ হয়ে গেছে।
বাইবেলে বর্ণিত বালক ডেভিড ছোট্ট পাথর দিয়ে লক্ষ্যে আঘাত করে মহাপরাক্রশালী গোলিয়াতকে ধরাশায়ী করেছিল। ইতিহাসের সেই বালক ডেভিডের অমিত সাহস নিয়ে ফিরে এসেছেন ফিলিস্তিনের যোদ্ধারা। স্বল্পমূল্যের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পরাভূত করেছে বিলিয়ন ডলারের ইসরায়েলি বাহিনীকে। যুদ্ধের প্রথম পর্বে ইসরায়েল পরাজিত হয়েছে নিরন্তর মার খাওয়া ফিলিস্তিনিদের হাতে, এ কথা বলাই যায়।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক