রাষ্ট্রের দাপটে অসহায় খাদিজা

আমার বয়স হচ্ছে, আগের মতো সভা-সমাবেশে যেতে পারি না এখন। তবু গুম বা ক্রসফায়ারের শিকার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে কর্মসূচি থাকলে যাওয়ার চেষ্টা করি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগীদের এমন একটি সমাবেশে গিয়েছিলাম মাস চারেক আগে। সেখানকার কথা শুনলে বারবার কিছু প্রশ্ন আক্রান্ত করে আমাকে, সেদিনও তা-ই হয়েছিল।

এই আইনে ভুক্তভোগীদের অধিকাংশ গ্রেপ্তার হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘সমালোচনা’ করে। তাদের প্রত্যেকে বহুবার জামিনের আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। কেউ কেউ জামিন পেয়েছিল সাত-আটবার আবেদন করার পর। তাদের মধ্যে দু-একজনের মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। কিন্তু নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে ইতিমধ্যে তারা জেল খেটেছিল বহু মাস। তারা প্রশ্ন করেছিল, দোষ না করেও কেন তাদের জেল খাটতে হলো? তাদের কারও কারও শিক্ষাজীবন, জীবিকা বা নিরাপত্তাবোধ বিপর্যস্ত হয়েছে সারা জীবনের জন্য। এর প্রতিকার কীভাবে বা কোথায় পাবে তারা?

ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে তাদের অধিকাংশকে জামিন পেতে হয়েছে হাইকোর্টের ব্যয়বহুল বিচারব্যবস্থায়। প্রশ্ন আসে, হাইকোর্ট যদি জামিন দেওয়ার যোগ্য মনে করেন, তাহলে বিচারিক আদালত কেন পারেননি আগেই তাদের জামিন দিতে? এর একটাই উত্তর হতে পারে। তা হচ্ছে, বিচারিক আদালতের বিচারককে বদলি, পদোন্নতি স্থগিত, ছুটি নামঞ্জুর বা হয়রানিমূলক তদন্ত করে শাস্তি দিতে পারে সরকার। এই ভয় হাইকোর্টের বিচারকদের নেই বলে তাঁরা কিছুটা হলেও স্বাধীন বিচার-বিবেচনাবোধের পরিচয় দিতে পারেন। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু নয়, অতীতে আমরা তাই বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জামিন, এমনকি মুক্তির আদেশ দিতে দেখতাম সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে। কয়েক বছর আগেও হাইকোর্টের এমন আদেশই ছিল চূড়ান্ত। রাষ্ট্রপক্ষকে এমন আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যেতে দেখা যেত না। গেলেও আপিল বিভাগ এসব আবেদন গ্রহণ করতেন না।

বর্তমানে আমরা এমনকি এরও ব্যত্যয় দেখছি। ভিন্নমতাবলম্বীদের পক্ষে হাইকোর্টের জামিনাদেশ বা কোনো প্রতিকারের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গিয়ে এটি আটকে দেওয়ার বহু ঘটনা ঘটছে এখন। সুপ্রিম কোর্টেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হাইকোর্টের জামিনাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাচ্ছে রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, এর আবেদন অনুসারে হাইকোর্টের জামিন স্থগিত করে দিচ্ছে আপিল বিভাগ। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার (খাদিজা) ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার।

দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই খাদিজা জেল খাটছে এগারো মাস ধরে। মাস দুয়েক আগে প্রথমবার আপিল বিভাগে তার জামিনের শুনানি স্থগিত করে দিলে আমরা পত্রিকায় তার মায়ের আহাজারি দেখেছিলাম। তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদও তার মেয়েকে করতে হবে জেলখানার ভেতর। কোরবানির ঈদের পর শুনানিতে এবার আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার জামিনের আবেদন শোনা হবে আরও চার মাস পর! 

এরপরও তার জামিন হবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই কোনো। 

আমরা এ দেশের উচ্চ আদালতকে বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। আমরা সেই গৌরবময় ভূমিকা স্মরণ করি। সে জন্য এই আশায় বুক বাঁধি যে আর কোথাও না হোক, উচ্চ আদালতে সুবিচার পাওয়া যাবে। খাদিজা বা কালো আইনে গ্রেপ্তার হওয়া যেকোনো ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও তা-ই হবে বলে আশা করি। রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতা আর কালো আইনের দাপটের সামনে খাদিজা অসহায় এক অল্পবয়সী শিক্ষার্থী। উচ্চ আদালত চাইলে তার জামিনের আবেদনের নিষ্পত্তি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করা সম্ভব।

২. 

জামিন কোনো অভিযোগ থেকে মুক্তির আদেশ নয়, এটি দোষ প্রমাণের আগে শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত থাকার এবং সেভাবে বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ। জামিন না দেওয়া মানে বিচারের আগেই কাউকে শাস্তি দেওয়া। মূলত এই বিবেচনায় উন্নত আইনব্যবস্থায় সিরিয়াল কিলার বা ভয়াবহ সন্ত্রাসী ছাড়া কাউকে জামিন না দেওয়ার ঘটনা ঘটে না। আমাদের দেশের আইনেও জামিন কাউকে দেওয়া যাবে না বলা নেই। এ দেশে ব্রিটিশ আমলে করা ফৌজদারি আইনে কম গুরুতর মামলায় জামিন পাওয়া হচ্ছে মানুষের অধিকারভুক্ত বিষয়। গুরুতর মামলায়ও কাউকে জামিন দিতে সেখানে নিষেধ করা হয়নি; বরং অল্পবয়স্ক, নারী ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জামিনের আবেদন সুবিবেচনা করার নির্দেশনা আছে। প্রতিটি বিবেচনায় খাদিজার জামিন পাওয়ার কথা বহু আগে।

খাদিজা যখন গ্রেপ্তার হয়, তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৪ এবং ২০ ধারা অনুসারে তাই তার বিচার হওয়ার কথা শিশু আদালতে। এ ছাড়া অল্পবয়স্ক, নারী ও কিডনি রোগী হিসেবে এমনিতেও তার জামিন পাওয়ার কথা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আমরা তার আইনজীবীদের কথায় যা জেনেছি, সে নিজে সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কোনো বক্তব্য দেয়নি। একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবে তার প্রশ্নের জবাবে প্রবাসের অবস্থানরত একজন ব্যক্তি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। উচ্চ আদালত তাহলে কী বিবেচনায় তার জামিনের আবেদন আবারও কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রেখেছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা জানি, ন্যায়বিচারের অন্যতম ম্যাক্সিম বা নীতি হচ্ছে ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, এটি যে করা হয়েছে, তা মানুষের কাছে প্রতিভাত হতে হবে। হাইকোর্টে জামিন পাওয়ার পরও একজন অসুস্থ শিক্ষার্থী মাসের পর মাস কেন বিচারের আগেই জেলে থাকবে, তা অনুধাবন করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। 

৩. 

আমাদের দেশের সংবিধানপ্রণেতারা গর্ব করে বলেছিলেন, এই সংবিধানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে, এতে কালো আইন জারির কোনো সুযোগ নেই। তাঁরা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভবিষ্যতে কালো আইন জারি করবে, এটি আশঙ্কা করারও কোনো কারণ নেই। বলেছিলেন, যদি এমন কোনো আইন জারি হয়, তাহলে তা বাতিল করার সুযোগ সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন, সুপ্রিম কোর্ট এটি করবেন। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নিপীড়নমূলক একটি আইন। এতে যেকোনো ভিন্নমতকে অপব্যাখ্যা করে যে-কাউকে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা সম্ভব। এই আইনে, এমনকি শিশু আইনকে অগ্রাহ্য করে একজন আট বছরের শিশুকেও বড়দের আদালতে বিচার করা সম্ভব। আইনটি বাতিলের মামলা আদালতে ঝুলে আছে বছরের পর বছর ধরে। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি নানা মহলের সমালোচনার মুখে সরকারের মন্ত্রীরা পর্যন্ত এর কিছু দুর্বল দিক এবং এর অপপ্রয়োগের কথা স্বীকার করেছেন। এমন একটি মানবাধিকার হরণকারী আইনে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাসের পর মাস আটকে আছে জেলখানায়। এ নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো বিকার নেই। এ দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও নারী সংগঠনগুলোও সেভাবে সোচ্চার নয়। কিন্তু এসবের চেয়ে বড় বেদনাদায়ক হচ্ছে, উচ্চ আদালত কর্তৃক তার জামিনের বিষয়টির শুনানি স্থগিত রাখার আদেশগুলো। 

আমরা এ দেশের উচ্চ আদালতকে বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। আমরা সেই গৌরবময় ভূমিকা স্মরণ করি। সে জন্য এই আশায় বুক বাঁধি যে আর কোথাও না হোক, উচ্চ আদালতে সুবিচার পাওয়া যাবে। খাদিজা বা কালো আইনে গ্রেপ্তার হওয়া যেকোনো ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও তা-ই হবে বলে আশা করি। রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতা আর কালো আইনের দাপটের সামনে খাদিজা অসহায় এক অল্পবয়সী শিক্ষার্থী। উচ্চ আদালত চাইলে তার জামিনের আবেদনের নিষ্পত্তি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করা সম্ভব।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক