চাকরির বয়সসীমা: ‘ যুক্তির চেয়ে আবেগ জয়যুক্ত হইল’

দাবিদাওয়ার চাপে জেরবার অন্তর্বর্তী সরকার ৩২–ঊর্ধ্বদের আন্দোলনের মুখে বয়স বিবেচনা কমিটি গঠন করে। সাবেক সচিব মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সেই কমিটি ইতিমধ্যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স পুরুষদের ৩৫ ও নারীদের ৩৭ করার সুপারিশ করেছে।

২ অক্টোবর যখন কমিটি আলোচনার জন্য বসেছিল, তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে বয়স বাড়ছে। বয়স বিবেচনা কমিটির প্রধান মুয়ীদ চৌধুরী সেদিন সাংবাদিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেশনজট, করোনাসহ বিভিন্ন কারণে চাকরিতে প্রবেশের বিদ্যমান বয়স বাড়ানো উচিত।   

অসুখ–বিসুখ, করোনা নাহয় দৈব–দুর্বিপাক। কিন্তু বাঁধাধরা বা ক্রনিক সেশনজট কেন হেতু হবে? আগে চাকরির বয়সের চাপ ছিল বলে ‘সেশনজট নিপাত যাক’ আওয়াজ তুলে সেশনজটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা যৌক্তিক ভিত্তি ছিল। এখন সেটাও আর থাকল না।

শিক্ষকেরা এখন কনসালট্যান্সি আর বেশি বেশি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়াটে শিক্ষক হয়ে দিন গুজরান করবেন। হয়তো বলবেন—৩৫ বছর ম্যালা সময়; ধীরে সুস্থে চলো, সেশনজট তোমাকে পথে বসাবে না। রায়ের বাইরে যেমন বিচারকের পর্যবেক্ষণ থাকে, মুয়ীদ কমিটিও তেমনি পর্যবেক্ষণ দিতে পারত। বলতে পারত, যেসব কারণে পড়ালেখা শেষ করতে করতে চাকরির বয়স পেরিয়ে যায়, সেগুলো রোধে, বিশেষ করে সেশনজট রোধে দায়িত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।  

বোঝা যায়, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কমিটিকে। আবার সিদ্ধান্তে নারীবান্ধবতার প্রলেপ দিতে গিয়ে নারীদের একটু বাড়তি খাতির করা হয়েছে। যেটা কোনো দাবিতেই ছিল না। বরং এবার কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় নারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা না রাখার পক্ষেই বারবার মত দিয়েছিলেন। ফেসবুকে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, নারীদের বয়সসীমা ৩৭ করার যৌক্তিকতা কী?

এ ক্ষেত্রে মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, আরও অধিকসংখ্যক নারী যেন চাকরিতে আসতে পারেন, সে জন্য তাঁরা এই সুপারিশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘ছেলেদের মতো ওই বয়সে মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। ফ্যামিলি অবলিগেশন্স থাকে, বিয়ে হয়ে যায়...। এ ছাড়া আমাদের নারী কর্মকর্তার সংখ্যা তুলনামূলক কম।...যাতে নারীরা এ সুবিধাটা পান, তাঁরা আসতে পারেন।’  

বয়স বিবেচনা কমিটির এসব বয়ান কতটা তথ্যভিত্তিক আর কতটা ধারণাপ্রসূত? সেটা আজ নাহয় কাল কেউ জিজ্ঞাসা করবেই। গত ১০ বছরের তথ্য দেখলেই বোঝা যাবে মেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সংখ্যায় পিছিয়ে পড়েন। সমস্যাটা এখানেই। স্নাতকে ভর্তি হওয়ার আগে সংখ্যায় কমে গেলে সময়মতো চাকরির দরখাস্ত তাঁরা করবেন কীভাবে? যোগ্যতাসম্পন্ন নারীদের চাকরিতে আনতে হলে কাজ করতে হবে গোড়ায়। তাঁরা যাতে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বয়সসীমা শিথিল করে যোগ্য নারীদের প্রশাসনে আনা যাবে না। 

আগে চাকরির বয়সের চাপ ছিল বলে সেশনজট ‘নিপাত যাক আওয়াজ’ তুলে সেশনজটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা যৌক্তিক ভিত্তি ছিল। এখন সেটাও আর থাকল না

বিষয়গুলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের চালক–চালিকারা যে বোঝেন না, এমন নয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ আলী ইমাম মজুমদার ২০১৮ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স যদি ৩৫ করা হয়, তাহলে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানো যাবে না। তরুণেরা যে অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন, সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?’ 

একই কথা চলতি সপ্তাহে সরকারের সদ্য সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলছেন। তাঁর মতে, ‘...২৪–২৫ বছর বয়সের একজন তরুণ কর্মকর্তাকে সরকার যেভাবে কাজের জন্য গড়ে তুলতে পারবে, ৪০ বছর বয়সী কাউকে দিয়ে সেটা সম্ভব হবে না।’

তাহলে কি যুক্তির চেয়ে আবেগকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে? কমিটির সুপারিশকে সাধুবাদ জানাতে গিয়ে বয়স বাড়ানো আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের আবেগকে বর্তমান সরকার মূল্যায়ন করেছে।’ এরপর কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য তিন দিনের সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আর সেটি না হলে আবারও আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।  

যার হয় না নয়ে, তার হয় না নব্বইয়ে

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা নিয়ে ক্যাডার সার্ভিসের চাকরির বয়সসীমা বাড়িয়ে ৫০ করে দিয়েছিলেন। মূলত উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে প্রতিটি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতে হবে—এমন চাহিদা থেকে তখন একটি বিসিএসের জন্য বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ’৮২ ব্যাচের ওই কর্মকর্তারা ‘৬৫০ ক্যাডার’ হিসেবে প্রশাসনে পরিচিত। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে তখন ৪৫ বছরের বেশি বয়সে চাকরি পেয়েছিলেন মাত্র ২০ জনের মতো। এটা ৪২ বছরের পুরোনো তথ্য। হালনাগাদ তথ্য কী বলে? চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হওয়া ৪৩তম বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৯ বছরের বেশি বয়সীদের উত্তীর্ণের হার খুবই কম। মাত্র ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ৪১তম বিসিএসে ক্যাডারের ২৯ ঊর্ধ্ব বয়সসীমার প্রার্থীদের হার ছিল ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৩৮তম বিসিএসের ২৯ ঊর্ধ্বদের উত্তীর্ণের হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪১৪ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, যাঁদের বয়স হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা আর পরীক্ষায় ভালো করছেন না। তুলনামূলকভাবে কম বয়সীরা এ ধরনের পরীক্ষায় ভালো করে থাকেন। সুপারিশকৃতদের মধ্যে ২৩ থেকে ২৭ বছর বয়সীদেরই বেশি ভালো করতে দেখা যায়। বয়স বাড়লে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ে। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করার সামর্থ্য কমে যায়। 

সাবেক অতিরিক্ত সচিব আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন যে সব ক্যাডারের জন্য এক বয়স ঠিক নয়। তাঁর মতে, পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন, কাস্টমসসহ কিছু সার্ভিসে বরং বয়সসীমা কমিয়ে ২৭ করা উচিত। এসব চাকরিতে প্রয়োজনীয় শারীরিক যোগ্যতা বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে পাওয়া কঠিন। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দায়িত্ব পালনের জন্য এসব সার্ভিসে প্রবেশের বয়সসীমা কমিয়ে ২৭ করলে দেশ উপকৃত হবে।

দাবির শেষ নেই

এদিকে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ গত ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আবেদন করেছে। ডিসি হওয়ার আন্দোলন যে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল, এখন অবসরে না যাওয়ার আন্দোলন যদি সেই রূপ ধারণ করে, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা যে করুণতর হবে তাতে সন্দেহ নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক, গবেষক 

nayeem5508@gmail.com