তিস্তা নদীতে যতবার ভাঙন দেখতে গিয়েছি, ততবারই ভীষণ মন খারাপ নিয়ে ফিরেছি। গত ঈদের দিন গিয়েছিলাম কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের গতিয়াশাম মৌজায়। সেখানে দেখলাম ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নৌকা থেকে দেখলাম একটি গরু পাড় ভেঙে নিচে পড়ে গেল। দেখলাম নদীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙন। ভাঙনকবলিত মানুষের মনে ঈদ নেই।
ঈদের এক সপ্তাহ পর আবারও গেলাম ওই স্থানে। নদীভাঙা মানুষগুলোর দিকে তাকানো কঠিন। তঁাদের সঙ্গে কথা বলা আরও কঠিন। তবু নির্মমের মতো আলাপ করলাম গাজী মিয়ার সঙ্গে। গাজী মিয়ার চার মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি ঢাকায় থাকেন। একজনের বাড়িতে কেয়ারটেকার। তিলে তিলে টাকা জমিয়ে একটি আধা পাকা ঘর তুলেছিলেন গাজী মিয়া। জীবনের সব সঞ্চয় সেখানেই খরচ করেছেন।
তিনি কল্পনাও করতে পারেননি নদী তাঁর বাড়ি গ্রাস করবে। বছর দুয়েক আগেও নদী ছিল আরও প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণে। মাত্র দুই বছরে তাঁর বাড়ি নদীগর্ভে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেই বাড়ির ইটগুলো সিমেন্ট থেকে আলাদা করা হচ্ছে। পাশেই তিনি বসে ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘বাঁধের রাস্তায় নতুন করি বাড়ি তুললাম। আমার তো যাওয়ার আর কোনো জায়গা নাই। বউ-সন্তানকে রাস্তায় রাখি ঢাকা যামো। ভবিষ্যতে কী আছে জানি না।’
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষকের বাড়ি এখনো ভাঙেনি। তবে তাঁর আড়াই একর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চোখে অশ্রু নিয়ে বলছিলেন, ‘আর ২০ শতক জমির উপরা বাড়িটা আছে। এটা গেইলে আর কিছুই থাকবে না। দেখেন যদি কিছু করা যায়!’
গতিয়াশামে একটি ক্লিনিক আছে। তার পাশে নদী যেভাবে ভাঙছে এবং নতুন পথ তৈরি করছে, এটা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে নদী যে সীমাহীন বিধ্বংসী আচরণ করবে, এই অনুমান স্থানীয় নদীপাড়ের সবাই করছেন। তিস্তা নদী গতিয়াশামে অনেকটা উত্তরে ঢুকে যাচ্ছে। গত দুই বছর যেভাবে নদী ভেঙেছে, একইভাবে ভাঙলে এ বছর তিস্তা-রাজারহাট সড়ক এবং রেলপথ নদীগর্ভে চলে যাবে।
সেটি হলে সিঙ্গারডাবরি নামক যে বড় হাট আছে, সেটি ও রাজারহাট উপজেলা সদর কোনো কিছুই রক্ষা পাবে না। নদীপাড়ের বয়স্ক ব্যক্তিরা বলছেন, এবার নদীর গতিবিধি ভালো নয়। এ নদীকে দুই শ বছর ধরে পাগলী নদী নামে ডাকে নদীপারের মানুষ। এমনভাবে নদী চর ফেলেছে যে পাড়ে গিয়েই আঘাত বেশি লাগছে। ফলে ভাঙন স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি হতে পারে।
ভাঙনে মানুষ কাঁদলেও কার্যত পাশে নেই সরকার। যাঁরা সহায়-সম্পদ হারিয়ে অসহায়-উদ্বাস্তু হন, সরকার তাঁদের সবার পুনর্বাসন করে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখছে না। পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা যে নামে হোক, তিস্তা নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটার তিস্তার দুই পাড়ের দৈর্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এর মধ্যে ৩২ কিলোমিটার ভয়াবহ ভাঙনপ্রবণ। এই ভাঙনপ্রবণ এলাকা বন্ধ করার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যে নদীতে বছরে লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেই নদীর পাড় সুরক্ষায় টাকা বরাদ্দ হয় না। চলতি অর্থবছরে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলেই নদীর ভাঙন বন্ধ করা সম্ভব হতো।
তিস্তাপারের ভয়াবহ অবস্থা আর সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব দেখে নদীর পাড় থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলাম রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, কুড়িগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। মুঠোফোনে আবেদন লিখলাম বিভাগীয় কমিশনার বরাবর। অনুলিপি দিলাম উল্লিখিত কর্মকর্তাদের বরাবর। বিভাগীয় কমিশনার হাবিবুর রহমান তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট একাধিকজনকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। ওই হতাশার মধ্যে খানিকটা আশার আলো ফুটল।
দীর্ঘ শুকনা মৌসুম গেল। ভাঙন যাতে না হয়, এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হলো না। যে স্থানে নদী তীব্র বেগে উত্তরে ঢুকছে, সেই স্থানটুকু সংস্কার করা যেত। সেটি করা হয়নি। যে স্থানে নদী দুই বছরে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, সেই স্থানে সরকার শুকনা মৌসুমে কোনো কাজ করেনি। এটা কি ভাবা যায়?
সামান্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেই তিস্তা নদীর এই ভয়াবহ ভাঙন রোধ করা সম্ভব ছিল। ভাঙন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে ভাঙন তীব্র হচ্ছে, বাড়ছে নদীর প্রস্থ। ৪০-৫০ বছর আগের দুই কিলোমিটারের তিস্তা এখন কোথাও কোথাও ১০-১২ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। গত বছরগুলোর ভয়াবহতা আমলে না নেওয়ার কারণে এখন যে পথে নদী যাচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কা করছেন নদীভাঙন অভিজ্ঞরা।
ভাঙনে মানুষ কাঁদলেও কার্যত পাশে নেই সরকার। যাঁরা সহায়-সম্পদ হারিয়ে অসহায়-উদ্বাস্তু হন, সরকার তাঁদের সবার পুনর্বাসন করে না। তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখছে না। পরিকল্পনা-মহাপরিকল্পনা যে নামে হোক, তিস্তা নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যার কোনো বিকল্প নেই। একটি স্থায়ী সমাধান লাগবেই। সেই কাজ শুরু করতে হবে এখনই। জনকল্যাণমুখী সিদ্ধান্ত তিস্তার জন্য এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেবল তিস্তা নয়, সারা দেশে যত স্থানে বর্ষায় ভাঙনের আশঙ্কা আছে, সবখানেই ভাঙন বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদীরক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক wadudtuhin@gmail.com