জাতিসংঘ ২০১২ সাল থেকে যে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ প্রকাশ করছে, তাতে ভুটানের অবস্থান কখনো ওপরের দিকে ছিল না। যার যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার দীক্ষার ভেতর দিয়ে ভুটান মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘাটতিতে পড়েছে।
বিশ্বজুড়ে ভুটান সুখী মানুষদের দেশ হিসেবে একটা ভাবমূর্তি তৈরি করে নিয়েছে। জনসংযোগে দেশটির শাসক গোষ্ঠীর বড় এক সফলতা এটি। এখানকার রাজবংশের চতুর্থ রাজা এবং বর্তমান রাজার বাবা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক ১৯৭২ সাল থেকে ‘জিএনএইচ’ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) নামে অর্থনীতির একটি অভিনব সূচকেরও জন্মদাতা হিসেবে আলোচনায় আছেন। তবে কথিত সুখী-সুখী ভাবমূর্তির আড়াল থেকে স্থলবেষ্টিত দেশটির সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির যেসব খবর মাঝেমধে৵ সামনে চলে আসে, তাতে ভুটানে সবাই শান্তিতে আছে এমন মনে হয় না।
আধুনিক ভুটান শাসন করে প্রায় ১১৫ বছরের পুরোনো ওয়াংচুক রাজপরিবার। থিম্পুর রাজপ্রাসাদ জনগণকে বলতে চায়—তোমাদের যা নেই সেসব না ভেবে যা আছে তা নিয়ে সুখে থাকো। রাজারা চাইছেন না অর্থনীতির সূচকগুলো দিয়ে নাগরিকেরা সুখ-শান্তির হিসাব-নিকাশে বসুক। জীবনযাপনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিয়ে নাগরিকেরা যাতে নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে মেলাতে না বসে—সেটিই রাজপরিবারের ইচ্ছা। বলা বাহুল্য, বিচক্ষণ রাজবংশ।
এই পরিবারের দর্শনের আলোকে সুখী মানুষদের দেশ হিসেবে ভুটানের ইতিবাচক আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দাঁড় করানোর সফল কাণ্ডটি ঘটেছে। করোনা মহামারির সময় প্রচারকেরা ভুটানের সুখী ভাবমূর্তিকে শক্তি জোগাতে এটিকে মহামারিমুক্ত দেশও বলছিলেন। বাস্তবে ভুটানের নাগরিকদের ৮ ভাগ করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন। মারা গেছেন কম, ২১ জন মাত্র (ওয়ার্ল্ড ডেটা ডট ইনফো)। ভুটান নিয়ে এ রকম আরও প্রচারণা আছে।
ভুটানে জন্ম নিলেও নেপালিভাষীরা সেখানে দ্রুকপা বৌদ্ধদের দ্বারা নানানভাবে বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ ছিল। নেপালিভাষীদের দাবি—রাজতন্ত্র ও তার প্রশাসনিক নিপীড়নের কারণে তাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁদের বড় অংশ (প্রায় সোয়া লাখ) বহুকাল শরণার্থীশিবিরে কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি উন্নত দেশে পুনর্বাসিত হলেও এখনো বহু শরণার্থী নেপালের শিবিরগুলোতে আছেন। প্রায় দুই-তিন বছর হলো জাতিসংঘ আর এসব শিবিরে সহায়তা দিচ্ছে না। এসব শরণার্থীর সহায়তা ও পুনর্বাসন নিয়ে নেপালের রাজনীতি ও প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়েছে সম্প্রতি। ‘সুখী ভুটানের’ অসুখ এভাবে পাশের দেশকেও কলুষিত করেছে।
যার যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার দীক্ষার ভেতর দিয়ে ভুটানে প্রথমত যা ঘটেছে—দেশটি উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘাটতিতে পড়েছে। জিডিপি বা প্রবৃদ্ধির জাতীয় তাগিদ না থাকায় ভুটান আশপাশের দেশগুলোর কাছে চিরস্থায়ী দুর্বল দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। আছে পরনির্ভরতাও। বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধানে সে অবস্থা ধরা পড়ে।
জাতিসংঘ ২০১২ সাল থেকে যে ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ প্রকাশ করছে, তাতে ভুটানের অবস্থান কখনো ওপরের দিকে ছিল না। ইতিমধ্যে এ রকম ১১টি বৈশ্বিক প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এ বছরের প্রতিবেদনে ভুটানের অবস্থান ৯৭। ফিনল্যান্ড লাগাতারভাবে গত ছয় বছর এই তালিকার শীর্ষে আছে। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্তের অভাবে ভুটান অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে আগের বছরগুলোতেও ভুটানের অবস্থান নিচের দিকে ছিল। যেমন ২০১৮ সালে ১৫৬ দেশের মধ্যে ভুটান ছিল ৯৭তম স্থানে। ২০১৬ সালে ছিল ১৫৭ দেশের মধ্যে ৮৪।
সুখী দেশের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভুটানের পিছিয়ে পড়ার বড় এক উপাদান—কাজের অভাব। ফলে তরুণ-তরুণীরা অনেকে বিদেশ যেতে উন্মুখ। সেই সূত্রে এখন ভুটানিদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের দেশ অস্ট্রেলিয়া। এরই মধ্যে সেখানে ৩০ হাজারের বেশি ভুটানি গেছেন (দ্য ডিপ্লোম্যাট, ১৯ অক্টোবর, ২০২২)। সরকারিভাবে অবশ্য সংখ্যাটা আরও কম বলা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব—২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে আছেন ৩২ হাজার ভুটানি। তবে সরকার স্বীকার করে, সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে।
কর্মহীনতা, কম মজুরি ও মূল্যস্ফীতি ভুটানিদের দেশ ছাড়ার বড় কারণ। শুধু কম বয়সীরা নয়, মধ্যবয়সী সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও চিকিৎসকেরাও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। মাত্র সাড়ে সাত লাখ মানুষের দেশটিতে শাসকদের জিএনএইচ তত্ত্বকে পেছনে ফেলে নাগরিকদের এভাবে দেশ ছাড়া সংবাদমাধ্যমেরও নজর কাড়ছে। ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে ভুটানে গড়ে প্রতিদিন তিনজনের বেশি সরকারি কর্মচারী চাকরি ছেড়েছেন বলে প্রতিবেদন ছেপেছে দ্য ভুটানিজ (৯ অক্টোবর ২০২২। ২০২১ সালে পুরো বছরে এ রকম চাকরি ছেড়েছেন ৮৯২ জন। তাঁদের অধিকাংশই অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন।
বিপদের দিক হলো, চিকিৎসক ও বিভিন্ন কারিগরি পেশার মানুষদের চলে যাওয়া। ভুটানে এ রকম দক্ষ পেশাজীবী বেশি নেই। যেমন ২০২১ সালের হিসাবে দেশটিতে ৩৫৪ জন চিকিৎসক এবং ১ হাজার ৬০৮ জন নার্স আছেন। এ থেকে ৫০ জন চিকিৎসক বা সমসংখ্যক নার্স চলে গেলে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সংকট তৈরি হবে।
একইভাবে কারিগরি পেশাজীবীদের বিদেশমুখী হওয়া থেকে আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার অবস্থা বাড়তি গতি পাবে। স্থানীয় পত্রপত্রিকা কিছুদিন পরপরই দেশের সম্ভাব্য এসব সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্পাদকীয় লিখছে। তাদের হাহাকারের কারণ, ভুটানিদের দেশান্তর হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মানুষের বিদেশ যাওয়ার মতো নয়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতায় উচ্চশিক্ষিত বা দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতির শঙ্কা কম। কিন্তু ভুটান শুরুতেই এই সমস্যায় পড়েছে।
অর্থনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে ভুটান পিছিয়ে থাকলেও দেশটিতে চমৎকার কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। ব্যাপকভাবে সবুজ এক দেশ ভুটান। এখানে বাতাস আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বিশুদ্ধ। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিও ভালো। তারপরও ‘কেন তোমরা দেশ ছাড়ছ’—এমন প্রশ্ন করলে অধিকাংশ প্রবাসী ভুটানি নিজ ভাষায় প্রথমে যে উত্তর দেবেন, তা হলো—‘গোকাপ রা মাইনডু’। এর বাংলা অর্থ ‘সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি’।
অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় দক্ষ একজন ভুটানি নিজ দেশের মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি আয় করছেন। তাঁর কাছে এটাই ‘সুখ’। ‘ব্রেন ড্রেন’ সামাল দিতে আইনপ্রণেতারা সরকারি কর্মচারীদের বেতনকাঠামো সংস্কারে হাত দিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁদের বার্ষিক ছুটিও ১২ দিনের জায়গায় ২১ দিন প্রস্তাব করা হয়েছে; কিন্তু সমাজের অন্যদের ধরে রাখা যাবে কীভাবে?
ভুটানে জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মানদণ্ড থাকলেও সেটি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৪ সালে, যা বাংলাদেশি টাকার হিসাবে পাঁচ হাজারের নিচে। স্থানীয় মুদ্রায় মাত্র ৩ হাজার ৭৫০ গুলট্রাম।
২০২২ সালের লেবার ফোর্স রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে ১৬ হাজার তরুণ চাকরি খুঁজছিলেন ভুটানে। বাস্তব সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হবে বলে জনসমাজে ধারণা করা হয়। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির পুরোনো এক খাত। অথচ তরুণেরা কৃষিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। ফলে আবাদি জমি খালি পড়ে থাকছে।
রাজতন্ত্র রাজনৈতিক খাতে কিছু সংস্কারের অনুমতি দিলেও অর্থনীতিতে কাঠামোগত সংস্কার হয়েছে সামান্যই। অর্থনীতির বহুমুখীকরণও ঘটছে না। ফলে রাজতন্ত্রের সুখের সংজ্ঞা তরুণদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
ভারত থেকে ভুটান অনেক ‘সহায়তা’ পায় এবং পেয়েছে দশকের পর দশক। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ১৭ বছর এ রকম সহায়তার পরিমাণ ছিল ৪১৭ কোটি ডলার। এসব সহায়তার একটি ফল হয়েছে ভুটানের অতিরিক্ত ভারতনির্ভরতা। বাণিজ্যের ৮০ ভাগ হচ্ছে এই প্রতিবেশীর সঙ্গে।
ভারত ছাড়া আর মাত্র দুটি দেশের দূতাবাস আছে থিম্পুতে, যা তার বাণিজ্যিক সম্পর্কের সীমাবদ্ধতাও নির্দেশ করে। একইভাবে ভারতের বাইরে মাত্র পাঁচটি দেশে ভুটানের দূতাবাস আছে। এই দুই তালিকাতেই যে কুয়েত আছে, তার কারণও মানবসম্পদ রপ্তানির সম্ভাবনা।
ভারতীয় ঋণ ও পরামর্শে ভুটান আয়–রোজগারের দ্বিতীয় রাস্তা হিসেবে জলবিদ্যুৎ ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। ওই সূত্রে এখন বিপুল ঋণের জালে আটকে গেছে তারা। বৈদেশিক দেনার ৭০ ভাগই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নেওয়া ভারতীয় ঋণ। এতে দেশটির অর্থনীতি পড়েছে নতুন আরেক চাপে। যে চাপ পরোক্ষে এসে পড়তে পারে সাধারণ ভুটানিদের ওপর। অর্থনৈতিক সূচকগুলো তাতে আরও খারাপ হবে।
২০২২ সালের আন্তর্জাতিক মানব উন্নয়ন সূচকে ১৯১টি দেশের মধ্যে ভুটানের অবস্থান ছিল ১২৭। সরকারি হিসাবে এখন দেশটিতে প্রতি ১০০ জনে ১২ জন ‘দরিদ্র’। ২০১৭ সালে প্রতি ১০০ জনে ছিলেন ৮ জন। মানুষের মাসিক আয় স্থানীয় মুদ্রায় ৬ হাজার ২০৪ গুলট্রাম ধরে ভুটানের পরিসংখ্যান ব্যুরোই ‘দারিদ্র্যে’র এই হিসাব কষেছে।
দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে গ্রাম-শহর বৈষম্যও প্রকট। শহরে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৪ দশমিক ২ ভাগ, গ্রামে সেটি প্রায় ১৮ ভাগ। একই জরিপে এ–ও দেখা গেছে, দেশের ওপরতলার ২০ ভাগ মানুষ নিচতলার ২০ ভাগের চেয়ে চার গুণ বেশি ভোগ করে। দেশটির প্রধান দৈনিক কুয়েনসেল এসব তথ্য জানাচ্ছে (২ জানুয়ারি ২০২৩)। অর্থাৎ ভুটানে বঞ্চনার সমস্যাটা কাঠামোগত। তারও একটি ফল নাগরিকদের দেশান্তর।
অর্থনৈতিক কারণে ভুটানিদের দেশান্তর সাম্প্রতিক ঘটনা হলেও রাজনৈতিক কারণে অপর দেশে বড় সংখ্যায় আশ্রয়ের ইতিহাসও আছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে প্রত্যাশিত রাজনৈতিক সংস্কার না হওয়া।
ওয়াংচুক রাজবংশের সৌভাগ্য বলতে হবে—ভুটানের রাজনৈতিক সংস্কার ও অনেক তথ্য আড়াল করে বহির্বিশ্বে অভিনন্দন পায়। বর্তমান রাজা এবং তাঁর বাবা ২০০৮ সাল থেকে দেশটিতে যে নির্বাচনী সংস্কৃতি বিকশিত হতে দিচ্ছেন, তার জন্য ব্যাপক প্রশংসা রয়েছে। এ বছরই ভুটানে আরেক দফা পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে পদক্ষেপ ফেলার ভুটানি অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রকৃতই গৌরবের। তবে গৌরবের এই প্রকাশে দেশটির পুরো পরিস্থিতি ধারণ দুরূহ।
এটা অনেকের অজানা ভুটানে এমন কয়েক ডজন রাজনৈতিক বন্দী আছেন যাঁরা দশকের পর দশক আটক অবস্থায় রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এ বছর ১৩ মার্চ এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে অনেক তথ্য সামনে এনেছে। আলোচ্য এই রাজনৈতিক বন্দীদের বড় অংশ ভুটানের নেপালিভাষী। ২০০৮ সালের আগে থেকে তাঁরা আটক আছেন। এইচআরডব্লিউ বলছে, তাঁদের অনেকে গুরুতর নির্যাতনের শিকার।
ভুটান সরকার সচরাচর রাজনৈতিক বন্দী বিষয়ে কোনো তথ্য দেয় না। তবে এইচআরডব্লিউ নিজস্ব সূত্রে এ পর্যন্ত এমন ৩৭ জন রাজবন্দীর হদিস পেয়েছে, যাঁরা ২০১০ সালের আগে বিভিন্ন সময়ে আটক। এর মধ্যে ২৪ জন বর্তমানে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন। তাঁদের আটক করা হয় কুখ্যাত ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইনে’। ১৯৯২ সালে ভুটান এই আইন করে।
সুখের জন্য বিখ্যাত একটি দেশে এ রকম একটি দমনমূলক আইন তৈরি বেশ বিস্ময়কর—যেখানে রাজা, দেশ এবং সরকারের সমালোচনা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজাযোগ্য করা হয়। এসব বন্দীর প্রত্যেককে পৃথকভাবে রাখা হয় এবং পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না বলে এইচআরডব্লিউ বলছে। এই বন্দীদের ‘অপরাধ’ তারা দেশটির দক্ষিণের নেপালীভাষীদের অধিকারের কথা বলছিল। ভুটানে তাঁদের ‘লোহটসাম্পা’ বলা হয়। এ রকম প্রায় ৯০ হাজার ভুটানি লোহটসাম্পা ১৯৯০ সালের পর থেকে নেপালে শরণার্থী হওয়া শুরু করেন।
ভুটানে জন্ম নিলেও নেপালিভাষীরা সেখানে দ্রুকপা বৌদ্ধদের দ্বারা নানানভাবে বৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ ছিল। নেপালিভাষীদের দাবি—রাজতন্ত্র ও তার প্রশাসনিক নিপীড়নের কারণে তাঁরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁদের বড় অংশ (প্রায় সোয়া লাখ) বহুকাল শরণার্থীশিবিরে কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ আটটি উন্নত দেশে পুনর্বাসিত হলেও এখনো বহু শরণার্থী নেপালের শিবিরগুলোতে আছেন। প্রায় দুই-তিন বছর হলো জাতিসংঘ আর এসব শিবিরে সহায়তা দিচ্ছে না। এসব শরণার্থীর সহায়তা ও পুনর্বাসন নিয়ে নেপালের রাজনীতি ও প্রশাসনে ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়েছে সম্প্রতি। ‘সুখী ভুটানের’ অসুখ এভাবে পাশের দেশকেও কলুষিত করেছে।
মূলত ভুটানকে ‘একধরনের মানুষের দেশ’ কায়েম করতে গিয়ে সেখানে লোহটসাম্পাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন প্রধান জনগোষ্ঠী ভুটিয়ারা। নেপালিভাষীরা অনেক দিন থেকে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলছেন, যা থিম্পুর শাসকদের পছন্দ নয়।
ফল হিসেবে সাড়ে সাত লাখ নাগরিকের দেশ থেকে এক লাখ লোহটসাম্পাকে প্রথমে ভারত হয়ে নেপালে এবং পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে যেতে হলো। এখন আবার অর্থনৈতিক কারণে খোদ ভুটিয়ারাও দেশান্তর হচ্ছেন। এটা ইতিহাসের এক বিরল বিয়োগান্ত ঘটনা যে ‘সুখী’ ভুটানের প্রধান দুই জাতিসত্তার মানুষ ভুটিয়া এবং লোহটসাম্পাদের অনেকের দেখা হচ্ছে এখন নিজ দেশের বাইরে বিশ্বের অন্যত্র।
নিজ দেশের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় অতি স্পর্শকাতর ছিল ওয়াংচুক রাজবংশ। কিন্তু তার নাগরিকেরা এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে চাইছেন বিশ্বসমাজে। জিএনএইচ তত্ত্ব তাঁদের মাতৃভূমিতে আটকে রাখতে পারেনি।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক