আওয়ামী লীগ—দল কি সরকারে হারিয়ে যাচ্ছে

৭৩ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত ৮ জন সভাপতি পেয়েছে। সাধারণ সম্পাদক পেয়েছে ১৫ জন। এর মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েকজন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা পদে আছেন ৪১ বছর— ১৯৮১ সাল থেকে।

সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সাল থেকে। দুই মেয়াদে তিনি ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সভাপতি পদে পরিবর্তন আসবে, এটা কেউ ভাবেন না। ফলে সম্মেলন সামনে রেখে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। কেউ বলছেন, বর্তমান সাধারণ সম্পাদকই আরেক মেয়াদে থেকে যাবেন। আবার কেউ বলছেন, সভাপতি নতুন কাউকে নিয়েও আসতে পারেন।

বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সম্মেলনস্থলের প্রস্তুতিকাজ দেখতে গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এবারের যে সম্মেলন, যে কমিটি হবে, এখানে তেমন একটা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।’ সেই সঙ্গে তিনি এ-ও যোগ করেছেন, ‘আমার জানামতে, এখানে অন্তত ওই পদের ১০ প্রার্থী আছেন; এই পদে আসতে চান। কে হবেন, এটা নেত্রীর ইচ্ছা এবং কাউন্সিলরদের মতামতের ওপর নির্ভর করছে।’

অনেক দলে সাধারণ সম্পাদক করার মতো নেতাই পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক পদে ১০ জন ‘যোগ্য প্রার্থী’ থাকলে বিষয়টি কাউন্সিলরদের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। আগে দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, জেল-জুলুম সহ্য করা এবং কর্মী তৈরি করাকে নেতৃত্বের গুণ হিসেবে গণ্য করা হতো।

তৃণমূল থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসে নেতারা কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নিতেন। এখন সব দলেই কর্মীদের সঙ্গে সংযোগ থাক বা না থাক, অতীতে দল করুন বা না করুন, যাঁর টাকা আছে, তিনি সহজেই নেতা হতে পারেন, এমপি-মন্ত্রী হতে পারেন। সত্তরের দশকে জিয়াউর রহমানের বিএনপি এবং আশির দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এই ধারা শুরু করেছিল।

এখন আওয়ামী লীগও তাদের অনুসরণ করে চলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ওই দুই দলকে ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমান জাতীয় সংসদের প্রায় ৭০ শতাংশ আসন ‘ব্যবসায়ীদের’ দখলে। আওয়ামী লীগ একসময় গরিব-দুঃখী মানুষের দল হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন আর সেটি ভাবার সুযোগ নেই।

ব্যবসায়ী নেতাদেরও রকমফের আছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী নিজের ব্যবসার টাকা রাজনীতিতে ঢালেন। তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ী দল করেন, মন্ত্রী-এমপি হন ব্যবসার প্রসার ঘটাতে। খেলাপি ঋণের মামলা থেকে রক্ষা পেতে।

১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন আহমদকেও একই যুক্তিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়তে হয়েছিল। এখনো মাঝেমধ্যে দল ও সরকার আলাদা করার আওয়াজ শোনা যায়। এমনকি অনেক সাবেক সংসদ সদস্যকেও বিগত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে দলকে সুসংগঠিত করার দোহাই দিয়ে। আবার অনেকে দলের বড় পদ ও মন্ত্রিত্বের স্বাদ দুটোই ভোগ করছেন।

২.

রাজনৈতিক মহলে একটা কথা চালু আছে যে বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ যতটা সফল, ক্ষমতায় থাকতে ততটা সফলতা দেখাতে পারে না। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ ছয় দফার আন্দোলন করেছে, সত্তরের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। কিন্তু স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। তরুণ নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে জাসদ গঠন করেন। আবার আওয়ামী লীগের ভেতরে যঁারা ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও নানা উপদল তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে সাত হত্যাকাণ্ড অনেক উদাহরণের একটি।

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করেছে। যখন দেখেছে এককভাবে আন্দোলন করে ফল পাওয়া যাবে না, সমমনা এমনকি বিপরীত রাজনৈতিক আদর্শের দলকে নিয়েও জোট করেছে। জোটবদ্ধ আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল আওয়ামী লীগ।

কিন্তু একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে সে রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। ফলে সরকার যত ক্ষমতাবান হয়েছে, দল তত ক্ষমতাবান হয়নি। বরং তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি বেড়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে এমপি, এমপির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের, উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কমিটির দ্বন্দ্ব চলছে প্রায় সবখানে। এ কারণে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে সব জেলায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। আবার সম্মেলন হলেও অনেকগুলো জেলায় কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।

তৃণমূলে আওয়ামী লীগের বিবাদের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২১ সালের ইউপি নির্বাচনে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ঘোষণা দিয়েছিল, যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন কিংবা মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে যাবেন, সবাইকে শাস্তি পেতে হবে। দল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে দেখলাম, সবাই সাধারণ ক্ষমা পেয়ে গেছেন। এমনকি গাজীপুরের যে সাবেক মেয়র বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে বরিশালের যে সংসদ সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, তাঁরাও সাধারণ ক্ষমার আওতায় এসেছেন। ক্ষমা চেয়েছেন দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানও। অর্থাৎ কেউ ক্ষমার বাইরে থাকছেন না।

যাঁরা দলের মনোনয়ন নিয়ে বিদ্রোহীদের কারণে হেরে গেছেন, তাঁরা এই সাধারণ ক্ষমা কীভাবে নেন, সেটাই দেখার বিষয়।

৩.

আওয়ামী লীগ সরকারে থাকতে তো বটেই, যখন বিরোধী দলে থাকে, তখনো রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এমনকি জাতীয় সংসদে যত কম আসনই থাক না কেন (১৯৭৯ সালে ৩৯টি, ১৯৮৬ সালে ৭৬টি, ২০০১ সালে ৬২টি) সংসদেও তারা রীতিমতো ঝড় তুলেছে। ক্ষমতাসীনদের অনেক গণবিরোধী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে।

কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বিরোধী দল তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও আওয়ামী লীগ রাজনীতির ওপর সেভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পারছে না। আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকায় চারটি তারা আছে। এই চার তারা হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বিরোধী দলে থাকতে তারা রাষ্ট্রীয় চার মূল নীতি নিয়ে খুব সোচ্চার ছিল। এখন দলটি সব ক্ষেত্রে আপস করে চলেছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনযন্ত্রের ওপর রাজনীতিরই কর্তৃত্ব করার কথা। কিন্তু কর্তৃত্ব করছে অদৃশ্য শক্তি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে কোনো কোনো সংসদ সদস্য মৃদু প্রতিবাদ করলেও দলীয় নেতৃত্ব সেটা বাড়তে দেননি। আজ আওয়ামী লীগের যে ২২তম সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে দলের কোনো ডেলিগেট-কাউন্সিলর এসব প্রশ্ন তুলবেন কি?

৪.

আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে অতীতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে সরকার ও দলের আলাদা সত্তা ফিরিয়ে আনতে দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।

১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন আহমদকেও একই যুক্তিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ ছাড়তে হয়েছিল। এখনো মাঝেমধ্যে দল ও সরকার আলাদা করার আওয়াজ শোনা যায়। এমনকি অনেক সাবেক সংসদ সদস্যকেও বিগত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে দলকে সুসংগঠিত করার দোহাই দিয়ে। আবার অনেকে দলের বড় পদ ও মন্ত্রিত্বের স্বাদ দুটোই ভোগ করছেন।

এই দ্বিমুখী নীতির কারণে সরকার ও দল কেবল একাকার হয়ে যায়নি, দলের যে পৃথক সত্তা, তা-ও হারিয়ে যেতে বসেছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com