১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের বর্ষপূতির ঠিক এক দিন পর হামাস বহুমুখী হামলা চালাল। যুদ্ধ দুটির মধ্যে সাদৃশ্যও লক্ষণীয়। দুঃসাহসী এবং অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ ইসরায়েলকে বিস্মিত করেছে। অপ্রতিরোধ্য দেশ হিসেবে তাদের যে গরিমা, সেখানেই তীব্র আঘাত হেনেছে এই হামলা। এখন দেখার পালা হামাসের এই হামলার পর ১৯৭৩ সালের মতো ইসরায়েলের রাজনীতিতে এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন আসে কি না।
মিসর ও সিরিয়া ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের গভীর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছিল। সংঘাতের প্রথম পর্যায়ে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ডায়ান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে দ্য আগ্রানাত কমিশনকে ইসরায়েল সরকার যুদ্ধ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
কমিশন গোয়েন্দা সংস্থার ‘দম্ভ’ বোঝাতে গিয়ে কনসেপজিয়া নামে একটি শব্দ ব্যবহার করেছিল। তারা বলেছিল, ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা ছিল আগ্নেয়াস্ত্রের যে মজুত আছে, তা আরবদের হামলা থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে মিসর যত দিন পর্যন্ত না বিমান হামলা ঘটানোর মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারছে, তত দিন পর্যন্ত ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা চালানোর সাহস তারা পাবে না।
এবারেও সেই গোয়েন্দা বাহিনী একই ধারণা পোষণ করেছে। তারা ভেবেছে, ইসরায়েলের শক্তির যে আধিক্য, তা হামাসকে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানো থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে তাদের যেসব রাজনৈতিক প্রভু আছেন, তাঁরাও ভেবেছিলেন, দখলদারির সময় ও সীমা দীর্ঘ হতে পারে। তবে এর বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের সহিংসতার যে প্রকাশ, তা নেহাত ‘ঝামেলা’ এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
হামাসের এই হামলা তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, যে সংগঠন ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের ধ্বংস চায় এবং ইসরায়েলি বেসামরিক জনগণকে জিম্মি করতে পারে, এমন কোনো সংগঠন ইসরায়েল সীমান্তে টিকে থাকতে পারে না।
আগ্রানাত কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার এবং দায়ান পদত্যাগ করেন। মেয়ার স্রেফ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে যান, দায়ান পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ হিসেবে বলেন, কমিশন তঁাকে পদত্যাগ করতে বলেনি। নেতানিয়াহু নিশ্চিতভাবেই দায়ানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। তবে এ কথা বলাই যায়, যে তাঁর ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি এত অসম্মানিত আর হননি। নেতানিয়াহু একনাগাড়ে ১১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের চাপে তিনি সুবিধা করতে পারছিলেন না বলে প্রায় ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। আর বলতেন, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট এলেই সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময় নেতানিয়াহু আমেরিকার দেওয়া ছাড় নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের জন্য লাভজনক কিছু করেননি।
১৯৭৩–এ যুদ্ধের ঘটনায় আগ্রানাত কমিশন অল্প কিছু সেনাসদস্যকে চাকরিচ্যুত করার পরামর্শ দিয়েছিল। এঁরা ছিলেন মূলত গোয়েন্দা শাখার সদস্য। এবারকার যুদ্ধের পর সেনাবাহিনীকে আত্মোপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। হামাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইসরায়েলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান প্রায়ই সন্ত্রাসী সংগঠনের অবকাঠামো ধ্বংসের কথা বলে এসেছে। হামাসের এই হামলা তাদের এই সুযোগ করে দিল। ইসরায়েলিরা এবার ভূমি দখলের দিকে এগোবে এবং সম্ভবত দীর্ঘ সময় দখলদারি বজায় রাখবে। হয়তো হামাস মাটির নিচে বাংকারে গিয়ে আশ্রয় নেবে। কিন্তু এই আশ্রয় কতটা নিরাপদ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে যথেষ্টই সুযোগ দেবে। বেসামরিক জনগোষ্ঠী হতাহতের ঘটনায় সাধারণত যে আওয়াজ ওঠে, তা–ও থামিয়ে দেওয়া হবে। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের পর এমনই ছিল পরিস্থিতি। কিন্তু হামাস নেতাদের বের করে দিতে বা তহবিল সংগ্রহে বাধা দিতে পশ্চিমা সরকার কাতার ও তুরস্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ইসরায়েলের ইতিহাসে হামাসের এই হামলা একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। মেয়ার পদত্যাগের পর তাঁর উত্তরসূরির স্ত্রীর বিদেশি ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই এক ঘটনায় ইসরায়েলে লেবারদের ২৯ বছরের ক্ষমতা লুপ্ত হয়। আজ ইসরায়েলিরা প্রতিশোধের শিঙা ফুঁকছেন। ডামাডোল থিতিয়ে আসার পর তাঁরা ভাবতে বসবেন। তবে ইসরায়েলি বামপন্থীদের উত্থান কিংবা শান্তি আলোচনার সূত্রপাত হবে, শিগগিরই তেমন সম্ভাবনা নেই।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
বারাক বরফি নিউ আমেরিকার সাবেক রিসার্চ ফেলো এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সাবেক ভিজিটিং ফেলো