দুঃখী মানুষের কৌতুক

মেষশাবক আর নেকড়ের গল্পটা আরেকবার মনে করি। একটা ভেড়ার বাচ্চা ঝরনায় পানি খাচ্ছে। তার উজানে একটা নেকড়ে এল। সেও পানিতে মুখ দিল। তারপর বলল, এই ভেড়ার বাচ্চা, তুই আমার পানি ঘোলা করছিস কেন?

মেষশাবক বলল, আপনি আমার উজানে। আমি ভাটিতে। পানি ঘোলা করার ব্যাপার থাকলে আপনিই আমার পানি ঘোলা করছেন। আমি তো আপনার পানি ঘোলা করছি না।

নেকড়ে বলল, তাহলে তোর বাবা আমার পানি ঘোলা করেছিল। বলে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেষশাবকের ওপর।

এই গল্প বলে ইশপ বলেন, খলের ছলের অভাব হয় না। তবে এই গল্পটা প্রযোজ্য ছিল ইশপের আমলে। এখনকার নেকড়েরা কোনো মেষশাবকের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে কাউকেই কোনো অজুহাত দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

এখন নেকড়েরা মেষশাবকদের ধরে ধরে ব্রেকফাস্ট করে, আর বলে, আগামীকালের ব্রেকফাস্টের জন্য আরও নাদুসনুদুস কটা ভেড়ার বাচ্চা পাঠিয়ে দিয়ো। আমাকে যেন কষ্ট করে আবার শিকার করতে বেরোতে না হয়।

এই রকম একটা ভেড়ার বাচ্চাকে তার মা বলল, বাবা, তুমি রেডি থেকো। কাল তোমাকে সকাল সকাল রাজার বাড়িতে পাঠানো হবে। তোমাকে খুব সুন্দর ড্রেস পরিয়ে দেব।

ভেড়ার বাচ্চা খুশি। রাজার বাড়ি যাব, রাজার বাড়ি। মা, কোন ড্রেসটা পরে যাব মা!
মা তাকে একটা সুন্দর পোশাক দেখালেন। পোশাক দেখে ভেড়ার বাচ্চা খুশিতে লাফিয়ে উঠল, দারুণ, দারুণ। এই রংটা আমার খুবই পছন্দ। মা, তোমাকে এক লক্ষ চুমু। তুমি আমার জন্য ঠিক জামাটাই বাছাই করে রেখেছ। মহারাজ নেকড়ে আমাকে দেখে কত খুশিই-না হবেন।

মা নীরবে চোখ মুছলেন।

সকালে নাশতার টেবিলে নেকড়ে বলল, পৃথিবীতে সুখ আর ন্যায্যতা নেমে আসুক। কী সুন্দর চলছে আমাদের রাজ্য। দেখুন, আমার প্রাতরাশের জন্য তিনটা মেষশাবক স্বেচ্ছায় হাজির হয়েছে। এই রকম সুন্দর ব্যবস্থা থাকলে সবকিছু ঠিক থাকে। আমাকে আর কষ্ট করে শিকারে যেতে হয় না। আর মেষসমাজেও অযথা আতঙ্ক থাকে না। তারা জানে, কবে কার পালা আসবে। ফলে তারা নিশ্চিন্তে সারাটা দিন বনজঙ্গলে, মাঠঘাটে ঘাস খেয়ে চরে বেড়াতে পারে।

এই সময় একটা ভেড়ার বাচ্চা বলল, মহারাজের জয় হোক। আপনার প্রাতরাশের থালায় আমি উঠতে পারব, আমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। আমাকে এই সম্মানের জন্য মনোনীত করায় আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। মহারাজ, এই নিয়মটা কেন করা হলো, জানতে পারি কি? মানে কেন মেষদের হাজির হতে হয় মহারাজদের খাদ্য হিসেবে?

মহারাজের একজন পাত্র বললেন, কারণ, বহু বছর আগে, তোমাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ ভেড়া আমাদের মহারাজ নেকড়ের কোনো এক পূর্বপুরুষের পানি ঘোলা করেছিল। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তও তোমরা করে যাচ্ছ বছরের পর বছর, বংশপরম্পরায়।

২.

আপনাদের যদি কখনো মন খারাপ হয়, আপনারা উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাবেন। উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনের ব্যালট পেপারে একটামাত্র প্রার্থীর নাম থাকে। এটাতে কোনো সিল দিতে হয় না, টিকচিহ্ন দিতে হয় না। তবে কারও যদি মনে হয়, তিনি এই প্রার্থীকে ভোট দেবেন না, তিনি কলম দিয়ে একটা ক্রসচিহ্ন দিতে পারেন। এটা করার জন্য গোপন ঘর আছে। তবে কারও ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে কেউ সেই গোপন ঘরে গিয়ে ঢুকবে। ব্যালট বাক্স থাকে প্রকাশ্য জায়গায়। ব্যালট পেপার সবার সামনে সেই বাক্সে ভরতে হবে। নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক উৎসাহ, এটা প্রমাণের জন্য সব ভোটারকে সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে আসতে হবে, যাতে দেখানো যায় যে বিপুল উৎসাহের সঙ্গে ভোটাররা ভোট দিতে এসেছেন।

ভোটের পর দেখা যায়, ভোট পড়েছে ৯৯ দশমিক ৯৯ ভাগ। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভোট পড়েছে ১০০ শতাংশ। সবার আগে কিম জং-উনের আসনের ফল প্রকাশিত হয়। তারপর বাকিদের। কিমের আসনে ভোট পড়ে ১০০ শতাংশ। আর বলা বাহুল্য, সবই পড়ে তাঁর পক্ষে।

ফল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিককে রাস্তায় নেমে আসতেই হবে। বাধ্যতামূলক। তারা রঙিন জামাকাপড় পরে রাস্তায় খুশিতে নাচতে থাকবে। তাদের মহান নেতা নির্বাচনে জিতেছেন। গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।

৩.

উত্তর কোরিয়ার ভোটপদ্ধতি দেখে যদি কারও মন খারাপ হয়, আপনারা গাজার শিশুদের কথা ভাববেন। দেশটা ছিল ফিলিস্তিনিদের। সেখানে ইসরায়েলিদের জন্য একটা ছোট্ট জায়গা করে দিল ব্রিটিশরা। তারপর ইসরায়েলিরা সরিয়ে দিতে লাগল ফিলিস্তিনিদেরই। আরব দেশগুলো এক হয়ে ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলকে যখন পরাস্ত করে ফেলেছে প্রায়, যুক্তরাষ্ট্র বলল, আমরা অ্যাটম বোমা ব্যবহার করব ইসরায়েলের পক্ষে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইসরায়েলি আক্রমণে গাজায় শিশু মারা গেছে ৫ হাজার ৫০০।

এবার চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন। এটা ২০২৩ সাল। মানুষ এআই আবিষ্কার করেছে। জেমস ওয়েব স্যাটেলাইট দিয়ে মহাবিশ্বের শুরুর ছবি দেখে তুলে ফেলেছে। কত মনীষী প্রার্থনা করলেন, অন্তর থেকে বিদ্বেষবিষ নাশো। জাতিসংঘের বয়স ৭৮। এই সময়ে স্রেফ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে হাজারে হাজারে, অথচ কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই।

ফিলিস্তিনি একটা শিশু, যার বয়স ২ বা ৩, সে যদি জিজ্ঞেস করে, আমরা মরছি কেন, তার জবাব কী!

৪.

মুক্তি না থাকলেও প্রতিবাদ জারি থাকতে হবে। আমাদের বলতে হবে, আমরা এই অন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার প্রতিবাদ করি। আমরা ভোটের মাধ্যমে আমাদের শাসক নির্বাচন করতে চাই। আমরা জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনের নির্বাচন চাই। কথা বলার স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা চাই।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক