‘আধপেটা খেয়ে নামতা মুখস্থ করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন খাওয়া। শিক্ষার আগে খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে হবে।’ কথাগুলো নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের।
৫ মার্চ বেলা একটা। রংপুর শহরতলির বড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাঈদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলছি। এ সময় কয়েক ছাত্র প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দিকে উঁকি দিল। একজন সহকারী শিক্ষক বললেন, ‘স্যার, বাচ্চারা খেয়ে আসেনি। বাড়ি যেতে চায়।’
এই ছাত্রদের দলে আটজন। তারা তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। প্রধান শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে ক্ষুধার্ত এই ছাত্রদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলি। চতুর্থ শ্রেণির একজন ছাত্র বলল, সকালে তার মা রান্না করেনি। সে চা-বিস্কুট খেয়ে এসেছে। এখন মাথা ঘুরছে। তৃতীয় শ্রেণির আরেক ছাত্র বলল, সে পাঁচ টাকা নিয়ে এসে শিঙারা খেয়েছে। টিফিনে বাড়িতে গিয়ে ভাত খাবে। (ক্ষুধার্ত শিশুদের নাম প্রকাশ করা হলো না)
বিদ্যালয়ের শিক্ষক আঞ্জুমান আরা বললেন, ‘৯০ শতাংশ শিশু শ্রমজীবী পরিবারের। ক্ষুধায় ওদের পেট ব্যথা করে, মাথা ঘোরে। বাচ্চারা স্কুল পালানোর চেষ্টা করে। সামনে দিন বড় হচ্ছে। কী যে বিপদ হবে!’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ক্ষুধা যে কী ভয়ানক বিপদ, তাহা আমরা কল্পনাও করিতে পারি না। অন্যান্য অনেক বিপদে মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জাগাইয়া তুলে—কিন্তু ক্ষুধায় মনুষ্যত্ব দূর করিয়া দেয়। ক্ষুধার সময় মনুষ্যত্ব অত্যন্ত ক্ষুদ্র’ (দুর্ভিক্ষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দী চলে গেল, তবু ক্ষুধার যন্ত্রণা থামল না। কেন?
রংপুর মহানগর থেকে গঙ্গাচড়া উপজেলার নবনীদাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অকপটে স্বীকার করলেন, অনেক বাচ্চা কিছু না খেয়ে স্কুলে আসে। দুপুরে ওরা ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে। কেউ কেউ অস্বাস্থ্যকর খাবার (চানাচুর, ঝালমুড়ি) খায়।
প্রধান শিক্ষক আনিছুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে দেখেন, শিশুশ্রেণির একটি বাচ্চা বিদ্যালয়ে হু হু করে কাঁদছে। পরে জানলেন, শিশুটি সকালে কিছু খেয়ে আসেনি, ক্ষুধা লেগেছে। তিনি (প্রধান শিক্ষক) ওই শিশুকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু দেখা গেল, শিশুটি খাচ্ছে না। শুধুই কাঁদছে।
প্রধান শিক্ষক আনিছুর রহমান উদাহরণ দিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে দেখেন, শিশুশ্রেণির একটি বাচ্চা বিদ্যালয়ে হু হু করে কাঁদছে। পরে জানলেন, শিশুটি সকালে কিছু খেয়ে আসেনি, ক্ষুধা লেগেছে। তিনি (প্রধান শিক্ষক) ওই শিশুকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু দেখা গেল, শিশুটি খাচ্ছে না। শুধুই কাঁদছে।
কবি বিমল চন্দ্র ঘোষের ভাষায়, ‘ক্ষুধাকে তোমরা বেআইনি করেছ, ক্ষুধিতদের আখ্যা দিয়েছ বিপজ্জনক।’ গঙ্গাচড়ার এক শিক্ষক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘বাচ্চারা প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করে, “স্যার, বিস্কুট কবে আসবে?” জবাব দিতে পারি না।’
সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রশ্ন, বাচ্চাদের পেটে যদি ক্ষুধা থাকে, তাহলে লেখাপড়াতে মন বসাবে কীভাবে? শিশুদের অভুক্ত রেখে ৯-৪ শিক্ষাঘণ্টা চালানো অন্যায্য নয় কি?
দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ৩৫ জেলার ১০৪ উপজেলার ১৫ হাজার ২৮৯টি স্কুলে এর আগে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি ছিল। অন্তত ৩২ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী এ কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিকর বিস্কুট পেত। প্রতিটি শিশুশিক্ষার্থীকে ৭৫ গ্রাম করে ফর্টিফায়েড বিস্কুট (১০টি) দেওয়া হতো। এ বিস্কুট একেকটি শিশুকে প্রতিদিন ৩৩৮ কিলোক্যালরি করে শক্তি জুগিয়েছে। ২১ বছর ধরে চলা সেই কার্যক্রম গত বছরের জুনে বন্ধ হয়ে যায়।
পুষ্টিবিদদের মতে, শিশু দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায়, অম্বল হয়, পেটে ব্যথা ও বমি বমি ভাব হয়। শারীরিক এই অস্বাচ্ছন্দ্য পড়াশোনা থেকে শিশুর মনোযোগ কেড়ে নেয় এবং শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধা দেয়। অর্থাৎ আমাদের চোখের সামনে একটা অপুষ্ট প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। (আরও পড়ুন, ‘স্কুলে অভুক্ত শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষতি’, নাজনীন আখতার, প্রথম আলো ৮ জুন ২০২৩)
গঙ্গাচড়ার একটি গ্রামে বাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে এক শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে ওই স্কুলের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে যাই। দেখা গেল, তৃতীয় শ্রেণিতে ৬০ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ১৬ জন। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ৪৪ ও ৩৪। উপস্থিত ১৮ ও ১৯ জন। শিক্ষক শামীম হোসেন বললেন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩০ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। কিন্তু টিফিনের পর বাড়িতে গিয়ে ১৪ শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফেরেনি।
একই এলাকার উত্তর বাগপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ১৬৯। প্রধান শিক্ষক রেমেনা খাতুন শিক্ষার্থীদের হাজিরা বই দেখে বললেন, ওদিন তৃতীয় শ্রেণিতে ২৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫, চতুর্থ শ্রেণিতে ২৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০ জন স্কুলে আসে। বেলা ৩টার দিকে প্রধান শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে ওই তিন শ্রেণিকক্ষে গিয়ে যথাক্রমে ১১, ৭ ও ৮ শিক্ষার্থীর দেখা মিলল। প্রধান শিক্ষক বললেন, অনেক বাচ্চা টিফিনে খাওয়ার জন্য বাড়িতে গিয়ে আর স্কুলমুখী হয় না। গঙ্গাচড়া ঘুরে দেখা গেল, অনেক শিশু স্কুলে না গিয়ে আলু ও তামাক তোলার কাজ করছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও রংপুরজুড়ে ‘মঙ্গা’ ছিল। তিস্তা নদীবিস্তৃত গঙ্গাচড়াও ছিল দারিদ্র্যপ্রবণ। তবে এখন দারিদ্র্যের ধরন বদলে গেছে। গঙ্গাচড়ার একাংশ সিটি করপোরেশনের চাপে ‘অপরিকল্পিত’ নগর হয়ে উঠছে। সেই গঙ্গাচড়ার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ধরলার চর, হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার দশা কী!
২০২১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, শিশুশ্রম কুড়িগ্রামে সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রামের মোট শিশুর ১৯ শতাংশই কোনো না কোনো শ্রমে জড়িত। কুড়িগ্রামের পর শিশু শ্রমিক বেশি বরগুনা ও দিনাজপুরে। ক্ষুধা–দারিদ্র্য না থামলে শিশুশ্রম বন্ধ হবে কি?
দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৩৩ লাখ শিক্ষার্থী পড়ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নিম্ন আয়ের ও শ্রমজীবী পরিবারের। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো এসব পরিবারে বিদ্যমান। তার ওপর এখন দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি। শিক্ষকেরা বলছেন, কোনো কোনো শিক্ষার্থীর পরিবারে এক বেলা রান্না হয়।
সরকার অবশ্য দেশের ৬১টি জেলার ৩০০টি উপজেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে টানা দুই বছর নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ পান করানোর পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
স্কুল মিল্ক ফিডিং প্রকল্পের বাস্তব চিত্র দেখতে গঙ্গাচড়ার ছালাপাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাই ৬ মার্চ। তিস্তাতীরবর্তী ওই গ্রামকে অজপাড়াগাঁও বললেও কম বলা হবে। এরপরও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ভালো দেখা গেল। পঞ্চম শ্রেণিতে ২১ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত মাত্র ২ জন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এখন ‘স্কুল মিল প্রকল্পে’ দুপুরে রান্না করা খাবারের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের দুধ, ডিম ও রুটি দিতে চায়।
পরীক্ষামূলকভাবে দেশের ১৫০ উপজেলার ১৯ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৫ লাখ শিক্ষার্থীকে বৈচিত্র্যময় খাবার দিতে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৪ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী এক অনুষ্ঠানে আগামী একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) বৈঠকে ‘স্কুল মিল প্রকল্প’ উঠবে বলে বলেছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এই বিনিয়োগ জরুরি।
জহির রায়হান প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক
rayhan.jahir@prothomalo.com