১৯৭৪ সালে পরিচালক ইবনে মিজান জিঘাংসা নামে একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন। এই সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমীন একটা গানে প্লেব্যাক করেছিলেন। প্রথম দুটি লাইন মনে আছে:
তুমি যে ডাকাত তুমি চোর
লুটে নিয়েছ হৃদয় মোর।
মন চুরির গল্প বেশ পুরোনো। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। এখনো চলছে। কিন্তু এই চুরি সেই চুরি নয়। চোর শব্দটা শুনলেই আমরা মনের আয়নায় কোনো রোমিও-জুলিয়েট কিংবা শিরি-ফরহাদকে দেখি না। চটজলদি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা লোক, সে কিছু একটা নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। তবে সেটা গোপনে। প্রকাশ্যে হলে আমরা বলি ছিনতাই। বড় রকমের চুরি-ছিনতাই হলে আমরা বলি ডাকাতি।
গল্প-উপন্যাসে চোর হচ্ছে ছিঁচকে। সে ঘুমন্ত গেরস্তের কাঁচা ঘরের সিঁধ কাটে। গেরস্তের হাঁড়িকুড়ি, লোটাকম্বল নিয়ে যায়। ডাকাত আসে রামদা-বন্দুক নিয়ে, নজর তার টাকাওয়ালা লোকের দিকে। সে থালাবাসন নেয় না। নেয় হিরে-জহরত, টাকাপয়সা। চোরের চেয়ে ডাকাতের মর্যাদা বেশি। আমরা শৈশবে চোর-পুলিশ-ডাকাত-দারোগা খেলেছি। সেখানে চোরের পয়েন্ট সবচেয়ে কম আর দারোগার সবচেয়ে বেশি। তবে ডাকাতের পয়েন্ট চোর-পুলিশ থেকে বেশি।
রবিনহুড ডাকাতিকে মহিমান্বিত করেছে। সে গরিবের বন্ধু, অত্যাচারীর যম। আমরা যারা রবিনহুড পড়ে বড় হয়েছি, আমরা তাকে খারাপ বলি না। এখন রবিনহুড দেখি না। দেখি শুধু চোর আর ডাকাত। কাজ একটাই—চুরি। রবিনহুড তো পরোপকারী। নিজের জন্য কিছুই রাখে না।
এখনকার চোরেরা লুটপাটের পর হাজার হাজার কোটি টাকা নিজেই হজম করে ফেলে। তার অনেকটাই পাচার করে দেয় বিদেশে। মাঝেমধ্যে কাঁটাবন থেকে ৩০০ টাকায় ক্রেস্ট কিনে মজলিশ জমিয়ে কিছুটা দাতব্য করে। অথবা গ্রামের বাড়িতে মসজিদ-মাদ্রাসা বানায়, মা-বাবার কবরে মার্বেল টাইলস লাগায়। এসব নিয়ে পত্রিকায় খবর হয়।
চুরি জিনিসটাকে আমাদের সমাজ কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। সমাজ বলতে বেশির ভাগ মানুষ। তারা চুরি করে না বা চুরি করার সুযোগ নেই। তবে চোরেরাও এ সমাজের লোক। আমাদের আশপাশে আছে। আমরা তাদের চিনি। দেখেছি, দশ-বিশ-তিরিশ বছর আগে খালি পায়ে কিংবা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে কোনো গ্রাম বা মফস্সল শহর থেকে দুরুদুরু বুকে ঢাকায় এসেছিল। হঠাৎ তার হাতে এল আলাদিনের চেরাগ। সে ফুলেফেঁপে উঠল। বণিক সমিতির নেতা হলো, ব্যাংকের মালিক হলো। সে এখন ‘সম্ভ্রান্ত’। আমাদের দেশে রাতারাতি মালদার হয়ে যাওয়া এই লোকগুলোর ঠিকুজি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই রকম। তারা এখন এলিট। কথায় বলে, ‘চোর ধনী হলে সজ্জন হয়’।
গত রোববার শুনলাম, চুরির দায়ে পি কে হালদারের ২২ বছরের জেল হয়েছে। তিনি চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি সবার ‘অলক্ষ্যে’ সরে পড়েছিলেন। ধরা পড়েন পশ্চিমবঙ্গে। সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ধরা না পড়লে আমরা হয়তো জানতেও পারতাম না। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে আরেকটি বচন—চোর চলে গেলে চৌকিদার আসে। আমাদের চৌকিদার তাঁকে ধরতে পারেনি। প্রশ্ন হলো, এক হালি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এতগুলো টাকা মেরে চম্পট দেওয়া কি এক হাতে সম্ভব? সে যা-ই হোক, পি কে হচ্ছে ‘টিপ অব দ্য আইসবার্গ’।
চুরি শব্দটা সেকেলে, ‘গ্রাম্য’। এর সুশীল প্রতিশব্দ হলো দুর্নীতি। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হলো। খবরের কাগজে যা দেখি ও আশপাশে যা শুনি, তাতে মনে হয়, এই ‘জিরো’র কোনো মূল্য কিংবা শক্তি নেই। এ যেন ‘চোরকে বলে চুরি করো, গেরস্তকে বলে সজাগ থাকো’। চোরেরা এসব গায়ে মাখে না।
চুরিচামারি বাড়ছে দিনকে দিন। কাশীরাম দাস বাংলায় মহাভারত লিখেছেন। তিনি অনেক আগেই বলে গেছেন, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। চুরি তার নেশা।
একটা লোকের বেঁচে থাকার জন্য কত সম্পদ দরকার! কথায় আছে—
দেহ খাবে পোকে
টাকা খাবে লোকে
এরপরও লোকে টাকার পেছনে ছোটে। সোজা পথে নয়, বাঁকা পথে। তাদের ধরা খুব কঠিন নয়। ইচ্ছা থাকলেই ধরা যায়। সেই ইচ্ছাই যেন নেই। এক চোর বিপদে পড়লে অন্য চোরেরা তার সমর্থনে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সখ্য আছে, আছে সংহতি। এ নিয়ে আছে প্রবচন—
চোরে চোরে আলি (আত্মীয়তা)
এক চোরে বিয়ে করে আরেক চোরের শালী।
গল্পে আছে, চার চোর এক গেরস্তের বাড়িতে চুরি করে চোরাই মাল নিয়ে পাশের এক আস্তাবল থেকে একটা খাটিয়া এনে মালের ওপর একজনকে শুইয়ে ভোরের দিকে ‘বলো হরি হরি বোল’ ধ্বনি দিয়ে পালাতে থাকে; পথে আরেক বাটপারের সঙ্গে তাদের দেখা। সে হেসে বলে, ‘গাড়ুর নল দেখা যাচ্ছে যে!’ চোরের দল বুঝতে পারে তারা ধরা পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি গাড়ুর নল ঢাকা দিয়ে তারা বাটপারকে বলে, ‘ভাগ নেবে তো চলে এসো।’ মুচকি হেসে ‘মেসো কবে মারা গেছে’ বলে বাটপার খাটিয়ায় কাঁধ লাগায়।
এই গল্পের সঙ্গে প্রবাদটির সংযোগ আছে। একই রকম প্রবাদ হলো, ‘চোরে চোরে কুটুম্বিতা’ কিংবা ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। চোরের পক্ষে অনেক লোক দাঁড়িয়ে যায়। মানুষ ধরে নেয়, সমর্থনকারীরাও চুরির ছিটেফোঁটা ভাগ পায়। ‘চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা’ কথাটা এসেছে এভাবে। স্বার্থের কারণে এক চোর অন্য চোরকে সমর্থন করে। যেমন আমরা বলে থাকি ‘শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল’।
অনেক সময় দেখি, চোরকে চোর বললে রাগ করে, খেপে যায়। নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে জোরগলায় অভিযোগকারীকে গালমন্দ করে। এখান থেকেই এসেছে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ কথাটি। এ হলো অপরাধ করেও নিরপরাধ সাজার চেষ্টা; অসৎ কাজ চাপা দেওয়ার জন্য আস্ফালন; যত বেশি অসৎ, তত বেশি সততার ভান। চোরেরও রণকৌশল আছে। হিন্দি-উর্দুতে বলে, ‘চোর মচায়ে শোর’। ধরা পড়লে চোর নিজেই ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করে ছুটে পালায়। তখন চোরের ওপর থেকে নজর সরে যায়। চোরদের দল আছে। এক দলের চোর অন্য দলের চোরকে বলে, আমাদের চোর ভালো, তোদেরটা খারাপ; আমরা পুকুরচুরি করেছি, তোরা করিস সাগরচুরি।
এত চুরিচামারির মধ্যেও সমাজে চোরবিরোধী মনস্তত্ত্ব বেশ জোরদার। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ চুরি পছন্দ করে না। তারা বেশির ভাগ ধার্মিক। ধর্মে আছে—চুরি করা পাপ। তারা চেষ্টা করে পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে। চোরও ধার্মিক। তবে তার জন্য আমাদের শব্দভান্ডারে আছে আলাদা শব্দ—বকধার্মিক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের মনে সহজাত ঘৃণা আছে। সেটা সে প্রকাশ করবেই। কখনো প্রতিবাদ করে, কখনো অভিশাপ দিয়ে। সমাজের মধ্যে এই শক্তি বহমান আছে বলেই এখনো দুনিয়া পুরোটা দোজখ হয়ে যায়নি।
চোর ধরা পড়লে, শাস্তি পেলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পায়, খুশি হয়। সে জন্যই মানুষ বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, কিংবা এ অন্যায় ধর্মে সইবে না। মানুষ ভাবে, চুরি করলে একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে। সে থেকেই এই প্রবাদের উৎপত্তি—চোরের দশ দিন গেরস্তের এক দিন।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক