মতামত

যে কারণে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে ইউরোপে বীতশ্রদ্ধ বাড়ছে

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হয়েছিল প্রায় এক বছর আগে। সেই যুদ্ধ থামানো নিয়ে কূটনৈতিক কোনো প্রচেষ্টার চেয়ে আরও অস্ত্র আরও শক্তি দিয়ে যুদ্ধের দামামাকে আরও প্রবল করা হচ্ছে।

শুধু ইউরোপ নয়, যুদ্ধের ধকল সইছে সারা বিশ্বের মানুষ।

এই যুদ্ধে সমস্যা কেবল এশিয়া বা আফ্রিকার মানুষদের হচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে ইউরোপের জনগণের। যখন সারা বিশ্ব অস্বস্তির মধ্য রয়েছে, তখন ন্যাটো সামরিক জোট বা ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়াকে কাবু করতে ইউক্রেনকে আরও কি মারণাস্ত্র বা আধুনিক ট্যাংক দেওয়া যায়, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কিছুদিন থেকেই জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক সরবরাহের জন্য মিত্রদের নিয়ে জার্মানির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। ভলোদিমির জেলেনস্কি ন্যাটো জোটকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আবার ইউক্রেনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলনিক তাঁর দেশের জন্য জন্য যুদ্ধবিমান এবং সাবমেরিন দেবার জন্য মিত্র দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

পশ্চিমা সাহায্য নিয়ে ইউরোপ মহাদেশের উত্তর-পূর্বাংশজুড়ে বিশাল রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেন কতটা জয়ী হতে পারবে তা নিয়ে ইউরোপে সংশয় বাড়ছে। পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার আমেরিকান যুদ্ধ নীতি নিয়ে ইউরোপে ক্রমেই সমালোচনা জোরদার হচ্ছে।

ইউরোপের মানুষদের যুদ্ধ নিয়ে অভিজ্ঞতা কম নয়। তারা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। তবে সেই যুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। মাঝে বলকানে ১৯৯০ সালে যুগোস্লাভিয়ার জাতিগত যুদ্ধ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন ইউরোপে অশান্তি ডেকে এনেছে।

ইউরোপে তীব্র শীতে প্রথমে মানুষ আশঙ্কায় ছিল রাশিয়ার গ্যাস আমদানি ছাড়া ঘরে ঘরে হিটার চলবে কীভাবে। শিল্পকারখানার চাকা কীভাবে ঘুরবে! কীভাবে ইউরোপ প্রায় চার মাস ধরে চলা তীব্র শীতকে মোকাবিলা করবে! জার্মানিসহ ইউরোপের আরও কিছু দেশের সরকার হঠাৎ মধ্যপ্রাচ্যগামী হয়েছিলেন। রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে অতি মূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি ক্রয় করার চুক্তি করছে। জার্মানি হঠাৎ তাদের সমুদ্রবন্দরে তরল গ্যাস মজুত করার টার্মিনাল স্থাপন করেছে। জার্মানিসহ ইউরোপের ধনী দেশগুলোর চাহিদা দেখে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশ এলএনজির মূল্য বাড়িয়েছে। তবে এতে করে ইউরোপের ধনী দেশগুলোর ততটা সমস্যা না হলেও সমস্যা হচ্ছে এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশের, যারা তাদের দেশে মধ্যপ্রাচ্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করত।

ইউরোপে অর্থনীতিতে সবল দেশ জার্মানি জ্বালানি খাতে কম আয়ের মানুষদের ভূর্তুকি দিয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা করছে, যাতে করে জ্বালানি ব্যবহারকারী জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ না করে। তবে জার্মানির মতো জ্বালানি বা পরিবহন খাতে ভর্তুকি ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের কারণে সেই সব দেশের জনগণ নাকাল হচ্ছেন। যুদ্ধের কারণে শুধু হাঙ্গেরি ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে রাশিয়ার গ্যাস আমদানি বন্ধ রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুধু জ্বালানির দাম নয়, বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। আগামীতে এই যুদ্ধ কত দিন চলবে আর মানুষের নাভিশ্বাস কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। মানুষ ক্রমেই এই যুদ্ধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছে, সোচ্চার হচ্ছে।

জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা ম্যার্কেলের সামরিক নীতিনির্ধারক উপদেষ্টা ছিলেন সাবেক ব্রিগেড-জেনারেল এরিখ ভাদ। যিনি ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। তিনি প্রথম থেকেই কোনো রাজনৈতিক কৌশল বা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছাড়াই ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। যদিও যুদ্ধের আগে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা ছিল। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনকে সমর্থন করা অবশ্যই সঠিক ছিল এবং আছে। কারণ, পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ আন্তর্জাতিক আইন মেনে হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত এর পরিণাম বিবেচনা করবার কথা তিনি বলেছেন! তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ইউক্রেন বা পশ্চিমা মিত্ররা কি দনবাস বা ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধার করতে চায়, না রাশিয়াকে পুরোপুরি হারাতে চায়! একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং কৌশলগত ধারণা ছাড়া শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে এই যুদ্ধের লেলিহান শিখা আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন এই জেনারেল।

তিনি জার্মানির বিখ্যাত নারীবাদী এমা পত্রিকার সঙ্গে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে, গত নভেম্বর মাসে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলির সঙ্গে সিএনএনের সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই সাক্ষাৎকারে জেনারেল মার্ক মিলি বলেছিলেন যে, ‘ইউক্রেনের সামরিক বিজয় আশা করা যায় না এবং আলোচনাই একমাত্র সম্ভাব্য উপায়। ইউক্রেনে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে শান্তি আলোচনার জন্য একটি দরজা খোলা থাকতে পারে, নইলে এই যুদ্ধ কেবল মানবজীবনের অর্থহীন অপচয় ঘটাবে।’ জেনারেল মিলির এই বক্তব্যের পর ওয়াশিংটনের সরকারি মহলে এবং জনসমক্ষে তিনি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। জার্মানির জেনারেল এরিখ ভাদ মনে করেন, জেনারেল মার্ক মিলি একটি অস্বস্তিকর সত্য কথা বলেছেন।

জার্মানিতে অনেকেই মনে করেন রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে এই যুদ্ধ জেদ ও ক্ষোভের সংঘাত। এমা পত্রিকাটির তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধের ১১ মাসে ইতিমধ্যে উভয় পক্ষের দুই লাখ সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা আহত হয়েছে। আর প্রাণ হারিয়েছে ৫০ হাজার সামরিক ও বেসামরিক মানুষ এবং বাস্তচ্যুত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ।

জার্মানির হ্যালে-ভিটেনবার্গ মার্টিন লুথার বিশ্ববিদ্যালয়র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং ইউরোপীয় রাজনীতির অধ্যাপক জোহানেস ভারউইক বার্লিনের টাগেস স্পিগেল পত্রিকাটিতে লিখেছেন, ‘ইউক্রেনে আজ যারা আরও অস্ত্র সরবরাহের কথা বলছেন, তাদের বোঝা উচিত, তাতে করে সংঘাত কমবে না বরং আরও বাড়বে। এই অস্ত্র সরবরাহ ইউেক্রনের উদ্দেশ্যহীন সংগ্রামকে আরও রক্তাক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করবে।’ তিনি মনে করেন পশ্চিমা কৌশল ইউক্রেনকে ধ্বংস করছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতাব্দী থেকে ইউরোপ যে শান্তির পথে হাঁটছিল, আর যুদ্ধ নয়, স্লোগান দিয়ে ইউরোপীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিল, তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

  • সরাফ আহমদ প্রথম আলোর জার্মানির প্রতিনিধি
    sharafahmed@gmx.net