ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আরও গঠনমূলক ভূমিকা প্রয়োজন। এ আলোচনার পর ইউক্রেনের সামনেও তাদের শর্তগুলো পুনর্বিবেচনার বিকল্প তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা বলেছেন, রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রিমিয়া ফেরত পেতে তাঁরা বলপ্রয়োগের চেয়ে বরং আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখতে চান।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি বন্দোবস্তের জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করা এবং সেটা সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এখনকার ঘটনাপ্রবহের সঙ্গে ২৫ বছর আগেকার উত্তর আয়ারল্যান্ডের ঘটনাপ্রবাহের পার্থক্য কম। ১৯৯৮ সালের ১০ এপ্রিল উত্তর আয়ারল্যান্ড ঘোষণা দিয়েছিল, শান্তি আলোচনার মধ্য দিয়ে তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। এর মধ্য দিয়ে ৩০ বছরের সংঘাতের অবসান হয়েছিল। সেই সংঘাতে তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে চূড়ান্ত যে শিক্ষা নেওয়ার আছে, তা হলো আলোচনা টেবিলে যুদ্ধ একমাত্র তখনই অবসান হতে পারে, যদি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের একেবারে মৌলিক স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে। একই সঙ্গে বন্দোবস্তটি বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে এবং সেটি সম্পাদনের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অর্জন সম্ভব নয় এবং সম্ভবত পুতিন যত দিন রাশিয়ায় ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন পর্যন্ত তা সম্ভব নয়।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় কারণ, সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে উত্তর আয়ারল্যান্ড যুদ্ধ যে প্রক্রিয়ায় অবসান হয়েছিল, তার একটি মূল্য রয়েছে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তিপ্রক্রিয়া থেকে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা উঠে এসেছে। প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে স্থানীয় নেতৃত্ব। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো যদি প্রকৃতপক্ষে শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তাহলেই কেবল একটি চুক্তি স্থায়ী হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি করে দিতে পারে। তৃতীয়ত, সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মুখ রক্ষা হয়, সে রকম একটা পথ অবশ্যই থাকতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে সেই পথ বের করতে হয়।
তৃতীয় শিক্ষার অর্থ হলো, একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে গেলে শুধু সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোই সম্মত হলে হবে না, তারা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং বাইরের কোন শক্তি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, সেটাও বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাস্তব প্রয়োগে গিয়ে যদি সংকট তৈরি হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতা আবার প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
উত্তর আয়ারল্যান্ড এবং অন্য অজস্র সংঘাতের ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায়, শান্তিপ্রক্রিয়া কখনোই আলোচনার টেবিলে বসেই শুরু হয় না। এর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি দরকার হয়। এর মধ্যে সক্রিয় নেতা ও অনুসারীদের কিনে নেওয়ার মতো ব্যাপারও থাকে, যাতে আলোচনার টেবিলে তাঁরা ইতিবাচক অবস্থান নেন।
রাশিয়ার আক্রমণ এবং ইউক্রেনের আসন্ন পাল্টা আক্রমণের ব্যাপারে এত কথাবার্তা চলছে যে দুই পক্ষের কেউই আলোচনায় বসার জন্য প্রস্তুত—সে রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন যে অবস্থান নিয়েছে, সেটা বোধগম্য। কারণ, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাদের বিশাল ভূখণ্ড রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। নিজেদের সেই ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার শর্তে শান্তি আলোচনায় বসা তাদের জন্য অর্থহীন।
অন্যদিকে, মস্কোর দাবি হচ্ছে, তারা যে ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, আলোচনার টেবিলে তাদের সেই অবৈধ দখলদারির স্বীকৃতি দিতে হবে। একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়া পর্যন্ত বিবদমান দুই পক্ষ লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কোনো মধ্যস্থতাকারীকে দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসানো ও টেকসই শান্তি স্থাপনে সহযোগিতা করতে হবে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্ষেত্রের সেই ভূমিকা অংশত পালন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও মধ্যস্থতার জন্য নিয়োজিত সিনেটর জর্জ মিচেলের ভূমিকা ছিল। ব্রিটিশ ও আইরিশ সরকারও তাদের সময়, সম্পদ ও অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামো নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। এ সবকিছুর মিলিত ফলাফলে একটি সফল চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো নিরপেক্ষ ও দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী নেই। তবে চীনের মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা রয়েছে। কিন্তু এই সংঘাতে বেইজিং রাশিয়াকে যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে, তাতে চীনের পক্ষে কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।
কিন্তু এ কথাও সত্য, চীনকে বাদ দিয়ে আবার মধ্যস্থতা করাও কঠিন।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্ষেত্রে টেবিলে বসার আগে দুই পক্ষকে যে পূর্বশর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেটাও শিক্ষণীয়। দুই পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসার যোগ্যতা হিসেবে অহিংসতার ৬টি শর্ত দিয়েছিলেন মিচেল।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে এর সমতুল্য হতে পারে, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি শর্তহীন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের শর্ত। ইউক্রেন নিয়ে এ পর্যন্ত চীন যতবার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে চীন এ বিষয়ের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। যাহোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে শর্তহীনভাবে আলাপ-আলোচনায় বসার প্রয়োজন নেই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থার সীমানাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপরও তা অব্যাহতভাবে প্রভাব ফেলে চলেছে। ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা ছাড়া যুদ্ধের টেকসই বন্দোবস্ত সম্ভব নয়।
এতে রাশিয়া, চীন ও পশ্চিমের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের বিষয়টির প্রতিফলন থাকতে হবে। ইউক্রেনকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য পথ খুঁজে বের করা ছাড়া কোনো কার্যকর বন্দোবস্ত সম্ভব নয়।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তি প্রতিষ্ঠা থেকে চূড়ান্ত যে শিক্ষা নেওয়ার আছে, তা হলো আলোচনা টেবিলে যুদ্ধ একমাত্র তখনই অবসান হতে পারে, যদি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে দুই পক্ষের একেবারে মৌলিক স্বার্থের প্রতিফলন ঘটে। একই সঙ্গে বন্দোবস্তটি বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে এবং সেটি সম্পাদনের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা অর্জন সম্ভব নয় এবং সম্ভবত পুতিন যত দিন রাশিয়ায় ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন পর্যন্ত তা সম্ভব নয়।
কিন্তু কিয়েভ, ব্রাসেলস, ওয়াশিংটন, বেইজিং অথবা বিশ্বের অন্য সব দায়িত্বশীল নেতাকে একত্র হওয়া প্রয়োজন এবং যুদ্ধ অবসানে কায়মনোবাক্যে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
স্টিফেন উলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত