ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসী যুদ্ধ তৃতীয় বছরে প্রবেশ করছে। ভালো অনেক অর্জন অবশ্যই আছে, কিন্তু দুশ্চিন্তারও অনেক কারণ আছে। এ প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এসেছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা সমর্থকেরা যা করেছে, তা এককথায় অসাধারণ। পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর রাশিয়া জনসংখ্যার দিক থেকে ইউক্রেনের চেয়ে সাড়ে ৩ গুণ, জিডিপির দিক থেকে ১০ গুণ, সামরিক খাতে জনবল ও অস্ত্রবলে কয়েক গুণ বড়। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন প্রায় সমানে সমান লড়ে গেছে। ইউক্রেন এখন তার ৮০ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে দুই বছর আগে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে যতটা ভূখণ্ড ছিল তার প্রায় কাছাকাছি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্যই এই হিসাব কষেছিলেন যে তার এই ইউক্রেন-বিজয় যুদ্ধ ২০১৪ সালের আগ্রাসনের মতোই হবে। সে সময়ে রাশিয়ান বাহিনী ঝড়ের বেগে অগ্রসর হয়ে ক্রিমিয়া ও পূর্ব দনবাস অঞ্চলের বিশাল একটা অংশ দখল করে নিয়েছিল।
পুতিন মনে করেছিলেন, ইউক্রেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল ও বিভক্ত। রাশিয়ার সেনাবাহিনী শক্তিশালী এবং ইউক্রেনীয়রা যতই প্রতিরোধ গড়ে তুলুক, তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে—জেনারেলদের এই প্রতিশ্রুতির ওপরও আস্থা রেখেছিলেন পুতিন।
পুতিনের এই সব অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এরপরও উদ্বেগের অনেক কারণ রয়েছে।
ইউক্রেনের ভূখণ্ড মুক্ত করতে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় অর্জন করতে অথবা অন্তত যাতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা যায়, সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে যে উচ্চ আশাজাগানিয়া পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শেষ পর্যন্ত অনেকটা আশাহত করেছে।
পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কীভাবে টিকে থাকতে হবে, সেটা ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছে রাশিয়া এবং দেশটি তার জ্বালানির বেশির ভাগটা চীন ও ভারতে রপ্তানি করছে।
ইউরোপ (দক্ষিণ কোরিয়া ও সম্ভবত জাপানসহ) এরই মধ্যে ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের নতুন আর্থিক প্যাকেজের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রেও এ রকম সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে করে রাশিয়ার হামলা তারা প্রতিরোধ করতে পারে এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালাতে পারে।
একইভাবে পশ্চিমা সামরিক নিষেধাজ্ঞাও রাশিয়া এড়াতে পেরেছে। চীন ও ভারতে তারা অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে আর উত্তর কোরিয়া ও ইরান থেকে তারা অস্ত্র কিনছে। বেসামরিক উদ্দেশ্যে কেনা প্রযুক্তি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। রাশিয়া তার প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাবারুদ সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেনের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে গেছে।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া যে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে তারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার লোকবল ক্ষয় (৩ লাখ রুশ সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন) বিস্ময়করভাবে বেশি হওয়া সত্ত্বেও দেশটির রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের বয়ান ব্যবহার করে ভিন্নমতের লোকদের শায়েস্তা করছে ক্রেমলিন। একই সঙ্গে রাশিয়ানদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে যে তাদের দেশ আগ্রাসী নয় বরং ভুক্তভোগী।
ইত্যবসরে, ইউক্রেনে রাজনৈতিক বিভক্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সদ্যই তাঁর শীর্ষ জেনারেলকে বরখাস্ত করেছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রিপাবলিকানরা মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্য ৬০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ আটকে দেওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে রীতিমতো ধুঁকতে হচ্ছে।
আইসোলেশনইজম (অন্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে না যাওয়ার জাতীয় নীতি) পুনরুত্থান, পুতিনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি সমবেদনা এবং নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জো বাইডেনের হাত শক্তিশালী যাতে না হয়, এমন দলীয় ভাবনা—একসঙ্গে মিলেমিশে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে এই বিরোধিতা এসেছে।
এটা ঠিক যে ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা প্যাকেজ পাস করিয়ে নেওয়ার জন্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দুই দলের সদস্যদের সমর্থন আদায় করে নিতে পারবেন বাইডেন। কারণ, সেটা মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তার জন্য তো অপেক্ষা করতে হবে। অথচ অস্ত্র ও গোলাবারুদের ঘাটতিতে পড়ার কারণে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে ইউক্রেনীয় বাহিনী পর্বতপ্রমাণ সমস্যার মধ্যে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো, মার্কিন সহযোগিতা স্থগিত হওয়ার কারণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটার কতটা ইউক্রেন ও দেশটির ইউরোপীয় বন্ধুরা পূরণ করতে পারবে?
ইউরোপ (দক্ষিণ কোরিয়া ও সম্ভবত জাপানসহ) এরই মধ্যে ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের নতুন আর্থিক প্যাকেজের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রেও এ রকম সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে করে রাশিয়ার হামলা তারা প্রতিরোধ করতে পারে এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালাতে পারে।
একই সঙ্গে ইউক্রেনের বন্ধুদেশগুলোকে এখন ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশে সহায়তা দিতে হবে, যাতে করে অন্য দেশের ওপর তাদের নির্ভরতা কমে।
একই সঙ্গে ইউক্রেনকে একটি প্রতিরক্ষামূলক সামরিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এতে করে ইউক্রেন তার প্রয়োজনীয় সম্পদ ও লোকদের রক্ষা করতে পারবে। ৮০ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ও সেটাকে রক্ষা করা ইউক্রেনের জন্য বাস্তবসম্মত ও অত্যাবশ্যক কৌশল। কিন্তু ইউক্রেনকে কখনোই এই ধারণা করা ঠিক হবে না যে ক্রিমিয়া, দনবাস ও রাশিয়ার দখলে থাকা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারটি তাদের হাতে নেই।
রিচার্ড হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট