হামাসের দাবি অনুযায়ী, তাদের নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ইরানে ‘জায়নবাদীরা’ হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক বজ্র কঠোর মুখ। এই যুদ্ধ চলাকালে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর তিন ছেলে নিহত হন।
তবে ইসমাইল হানিয়া বরাবরই কঠোর ভাষায় কথা বললেও, বহু কূটনীতিক তাঁকে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কট্টরপন্থী অন্য নেতাদের তুলনায় মধ্যপন্থী ঘরানার নেতা হিসেবে দেখেছেন।
২০১৭ সালে হামাসের শীর্ষ পদে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে হানিয়া তুরস্ক এবং কাতারের রাজধানী দোহায় যাওয়া–আসার মধ্যে ছিলেন। এই দুই দেশে বিভিন্ন সময় অবস্থান তাঁকে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আলোচক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম করেছিল।
হামাসের ভাষ্যমতে, ইসমাইল হানিয়ার তিন ছেলে—হাজেম, আমির ও মোহাম্মদ গত ১০ এপ্রিল গাজায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। হামাস বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় হানিয়া তাঁর আরও এক ছেলে, তিন মেয়ে ও চার নাতিকে হারিয়েছেন।
ইসরায়েল দাবি করেছিল, হানিয়ার নিহত ছেলেরা হামাসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু হানিয়া সে সময় ইসরায়েলের দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, তাঁরা হামাসের যোদ্ধা ছিলেন না। তাঁর সন্তানেরা নিহত হওয়ার পর যখন হানিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁদের হত্যাকাণ্ড যুদ্ধবিরতির আলোচনায় প্রভাব ফেলবে কি না, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনের জনগণের স্বার্থ সবার ওপরে’।
গত এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের পুলিশ হানিয়ার এক বোনকে গ্রেপ্তার করেছিল। সে সময় ইসরায়েলি পুলিশ এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেট বলেছিল, হানিয়ার ওই বোন হামাস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং ইসরায়েলের যে এলাকায় তিনি থাকতেন, সেখানে তিনি ‘সন্ত্রাসী হামলা’ উসকে দিতেন।
ইসমাইল হানিয়া জনসমক্ষে কঠিন ভাষায় বক্তব্য দিতেন। তবে আরব কূটনীতিক ও কর্মকর্তারা মনে করতেন, গাজায় তিনি তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট বাস্তববাদী নেতা ছিলেন। ইসমাইল হানিয়া যে মুহূর্তে বলছিলেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে ‘গাজার বালুতে ডুবিয়ে দেওয়া হবে’, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি এবং তাঁর পূর্বসূরি হামাস নেতা খালেদ মেশাল কাতারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ইসরায়েলি সেনাদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী থাকা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বিভিন্ন মহলে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
২০১৭ সালে যখন হানিয়া গাজা ছাড়েন, তখন তিনি ইয়াহিয়া সিনওয়ারের স্থলাভিষিক্ত হন। সিনওয়ার দুই দশকের বেশি সময় ইসরায়েলি কারাগারে কাটিয়েছিলেন। ২০১১ সালে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে সিনওয়ার মুক্তি পাওয়ার পর গাজায় ফিরলে হানিয়া সে সময় তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
কাতার ইউনিভার্সিটির ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আদিব জিয়াদেহ হানিয়া নিহত হওয়ার আগে বলেছিলেন, ‘হানিয়া আরব সরকারগুলোর সঙ্গে হামাসের রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’ জিয়াদেহ বলেছিলেন, ‘হানিয়া হামাসের একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ফ্রন্ট।’ হানিয়া ও খালেদ মেশাল মিসরে গিয়ে সেখানকার সেই সব কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যাঁরা যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করছিলেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে দেখা করতে নভেম্বরের শুরুতে হানিয়া তেহরানে গিয়েছিলেন। যুবা বয়সে হানিয়া গাজা শহরের ইসলামি ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়াশোনা করছিলেন, তখন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন।
১৯৮৭ সালে প্রথম ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা গঠনের সময় তিনি হামাসে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং অল্পকালের জন্য তাঁকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে হানিয়া হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসিনের একজন বিশিষ্ট খাদেম হয়ে উঠেছিলেন। হানিয়ার পরিবারের মতো ইয়াসিনের পরিবারও আশকেলনের নিকটবর্তী আল জুরা গ্রামের শরণার্থী ছিলেন।
১৯৯৪ সালে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হানিয়া বলেছিলেন, ইয়াসিন তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য একজন রোল মডেল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা তাঁর কাছ থেকে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং ইসলামের জন্য নিজেদের কোরবানি করা শিখেছি এবং এই অত্যাচারী ও স্বৈরাচারীদের কাছে নতজানু না হওয়া শিখেছি।’
পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে ইয়াসিনকে ইসরায়েল হত্যা করেছিল। হামাসকে সশস্ত্র গ্রুপ থেকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার বিষয়ে সর্ব প্রথম যে কয়জন হামাস নেতা চেষ্টা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে হানিয়া প্রথম সারিতে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বলেছিলেন, হামাস রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তাদের পক্ষে উদ্ভূত নানা ধরনের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ মোকাবিলা করা সহজ হবে।
হানিয়ার এই প্রস্তাব প্রাথমিকভাবে হামাস নেতৃত্ব খারিজ করে দিলেও পরে তা অনুমোদিত হয়েছিল। এবং তার ধারাবাহিকতায় গাজা থেকে ইসরায়েল ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার এক বছর পর ২০০৬ সালে হামাস ফিলিস্তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুবাদে হানিয়া ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।
হামাস ২০০৭ সালে গাজার শাসনভার গ্রহণ করে। ওই সময় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হামাসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ গ্রুপের মাহমুদ আব্বাস। মাহমুদ আব্বাস ওই বছরই হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। ২০১২ সালে হানিয়াকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, হামাস সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেছে কি না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই না’। তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক—সব ধরনের প্রতিরোধ জারি থাকবে।
রয়টার্স থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত