নিষিদ্ধ আদর্শ প্রকাশনী: বাংলা একাডেমি যখন দমন–পীড়নের হাতিয়ার

পেরেকবিদ্ধ ‘গীতাঞ্জলি’ হাতে বাক্রুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ৷ মুক্তচিন্তা, সৃজনশীলতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর সেন্সরশিপের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ভাস্কর্য
ছবি : প্রথম আলো

বর্তমান যুগ সর্বজনীন সহমতের। গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসাতে না পারলে এখানে ‘ভিন্নমত’ তকমা সেঁটে যায়। অন্যদিকে সত্যিকারের ভিন্নমতের স্থান ক্রমে সংকীর্ণ হতে হতে হয়ে এসেছে প্রায় নিশ্চিহ্ন। রাষ্ট্রীয় তো বটেই, এখন সামাজিক (যোগাযোগমাধ্যমের) জীবনেও কেবল ‘সহমত ভাই’ ‘সহমত ভাই’ বলাটাই ভব্যতা। ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিকভাবে ভিন্নমতের ভাষা প্রতিষ্ঠা ও ভাষা উদ্‌যাপনের মাস। সেই সূত্রে বলা যায়, ইদানীং ভিন্নমতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতার এক উদাহরণ হয়ে উঠেছে আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করে রাখা।

বাংলা একাডেমি গত ১৭ জানুয়ারি জানায়, বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ না করার কারণে তারা আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ করা থেকে বিরত থাকবে। তাদের আপত্তি ছিল আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পাওয়া একটি বই, বাঙালির মিডিওক্রিটির সন্ধানে বইটির প্রদর্শন ও বিক্রিসংক্রান্ত। উল্লেখ্য, বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের বইমেলায়। তখন নির্বিঘ্নে তা বইমেলায় প্রদর্শিত ও বিক্রি হয়েছিল, যার তৎকালীন ক্রেতা হিসেবে অনেকেই সাক্ষী দিতে পারেন।

লক্ষণীয় বিষয়, বইটি নিষিদ্ধের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যায় যায়নি, কেবল নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে শ্লীল-অশ্লীল, রুচি বা অনুভূতিতে আঘাতজাতীয় কথাবার্তা এসেছে, যা নিতান্তই ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে। কারণ, শ্লীলতা বা রুচির কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। যেহেতু বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে ধারণার গভীরে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, সুতরাং অন্যদেরও এখান থেকে কোনো ধারণা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমাজের গড্ডলিকাপ্রবাহের ধারায়, অনলাইন বই পরিবেশনের বড় প্রতিষ্ঠান রকমারি ডট কমের তালিকা থেকে বইটি তুলে নেয়। এরপর কলকাতা বইমেলায় বইটি প্রদর্শনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসে। পরে চট্টগ্রামে বইমেলাতেও আদর্শ প্রকাশনীকে বইটিসমেত একইভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উদ্যোক্তা প্রকাশকেরা আদর্শ প্রকাশনীকে চট্টগ্রাম মেলায় কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারেননি। শুধু জানা গেছে, তাঁরা ‘আদিষ্ট’ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোটামুটি বিষয়টি ধারণা করা চলে, সরকারের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি যেহেতু মেলায় আদর্শকে নিষিদ্ধ করতে চায়, তাই তাঁরা সবাই সেটাই চান। একেই বলে গড্ডলিকাপ্রবাহ। এতে গা ভাসালে সুবিধা হলো নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করতে হয় না, নানা রকমের সরকারি সুবিধার যোগ্যতাও মেলে।

যা-ই হোক, বাংলা একাডেমি প্রথমে তাদের বিবৃতিতে বলেছিল যে তিনটি বই তাদের সামনে হাল আমলে উপস্থাপিত হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যদিও পরে যা একটিমাত্র বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগে এসে ঠেকে, যে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপর ২০২২ সালে নির্বিঘ্নে বইমেলায় আদর্শের স্টলে বিক্রি হয়েছিল। পরে বইগুলো প্রদর্শন ও বিক্রি বাদ দিয়ে আদর্শকে বইমেলায় স্থান দেওয়ার কথা বলা হয়, আদর্শ শর্তে রাজিও হয়; কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাংলা একাডেমি তখন নিজের অঙ্গীকার পালনে বেঁকে বসে। তখন আদর্শের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট আদর্শকে মেলায় স্থান দেওয়ার আদেশ দেন। বাংলা একাডেমি তখন আদর্শকে স্টল বরাদ্দ না দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করতে আপিল করে। আপিলের ছলে লিখিতভাবে জানায় যে ২০২২ সালের বইমেলায় যখন বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন আদর্শকে মৌখিকভাবে বইটি প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এটা যদি সত্য হয়, তবে আগের (১৭ জানুয়ারি, ২০২৩) বিবৃতিতে বইটি আকস্মিক তাদের সামনে উপস্থাপিত হওয়ার কথা এল কী করে? কোনটা সত্য, ১৭ জানুয়ারির কথা, নাকি আপিলে যা বলা হলো সেটা? আপিলের ভাষার মাধ্যমে বাংলা একাডেমি নিজেই নিজের আগের বিবৃতিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে কিংবা আপিলে যা বলা হলো, তা সত্য নয়। আদর্শ প্রকাশনীর মালিকের দাবি, প্রথম বিবৃতি প্রকাশের আগে (২০২২ বইমেলায় বা তার পরের এক বছরে) কখনোই বইটি প্রদর্শনের বা বিক্রির ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি। বিষয়টি এমনিতেও প্রকাশিত ঘটনার ধারাবাহিকতা যাচাই করলে উপলব্ধি করা যায়।

এই যদি আমাদের অতীত হতো, ভয়ের সংস্কৃতিতে ভিন্নমতের স্থান না থাকত, তবে আজ আমাদের মুখে আমাদের মাতৃভাষা থাকত না, আমরা বিচরণ করতাম না সার্বভৌম স্বাধীন জাতি হিসেবে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো। আজ সরকারি প্রতিষ্ঠান যা বিনষ্ট করতে উদ্যত।

যা-ই হোক, দূরের বাদ্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ’ জিকির তুললে সুবিধা আছে। এতে ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করা যায়। সরাসরি নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও দূরবর্তী প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞা পালন না করলে নিজেদের অস্তিত্বের ওপর হুমকি আসতে পারে, এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত। যে দেশে নানা রকম দমন-পীড়নের আইন আছে, সর্বোপরি ডিজিটাল আইন আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার ও টানাহেঁচড়ার ভয় আছে, সেখানে শুধু শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের আদেশ অমান্য করার ধৃষ্টতা কেউ দেখায় না, তার ওপরে আইন বা নির্দেশটি প্রত্যক্ষভাবে বলবৎ হলেও বা না হলেও। এর ওপরে আছে দমন-পীড়নে সাহায্যকারীর জন্য সরকারের তরফ থেকে পুরস্কার। ‘ভিন্নমত’ দমন-পীড়নে আগে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হতো, এখন বাংলা একাডেমির মতো স্বায়ত্তশাসিত ও শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলা একাডেমির ঘোষিত উদ্দেশ্য, ‘সমকালীন শিল্প ও সাহিত্য সংরক্ষণ এবং গবেষণা উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষসাধন’, কাজটি পুলিশি কায়দায় বাস্তবায়িত করাকে অনেকটা অবাস্তব বলেই প্রতিভাত হয়। এর জন্য প্রয়োজন সংস্কৃতির প্রতি উদারতা, সহনশীলতা এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, যা সত্যিকার অর্থে একুশের চেতনা।

তবে নিষিদ্ধের ঘটনাটি সরকারিভাবে দমন-পীড়নের সফলতায় পুরস্কার বিতরণের বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিতে পারে। ২০১৯ সালে পুলিশ সপ্তাহে ৪০০ পুলিশকে পদক দেওয়া হয়েছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও তথাকথিত ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণামূলক’ সাক্ষাৎকারের জন্য গ্রেপ্তারে পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ। চলতি বছরেও গেজেট ছাপিয়ে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের সফলতার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। নিউ এজ পত্রিকা পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের সম্মাননাপত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে বিষয়টিতে কী পরিমাণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা ব্যবহার করা হয়েছে (সূত্র: পুলিশ অফিসার্স অ্যাওয়ার্ডেড ফর ফয়েলিং অপজিশন র‌্যালিজ, ৫ জানুয়ারি ২০২৩)।

এসব উল্লেখের উদ্দেশ্য হলো একদিকে যেমন প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমত দমনের প্রচেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, শিল্প-সংস্কৃতি রক্ষায় নিয়োজিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানও তাতে একইভাবে উৎসাহিত বোধ করছে। আর রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপরের স্তর থেকে যে দমন-পীড়নের সংস্কৃতি নিচের দিকে ধাবিত হচ্ছে, অন্যান্য সংগঠন ও ব্যক্তি, যাঁরা সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরাও নিষেধাজ্ঞা পালনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছেন নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি কাজে না লাগিয়ে।

এই যদি আমাদের অতীত হতো, ভয়ের সংস্কৃতিতে ভিন্নমতের স্থান না থাকত, তবে আজ আমাদের মুখে আমাদের মাতৃভাষা থাকত না, আমরা বিচরণ করতাম না সার্বভৌম স্বাধীন জাতি হিসেবে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো। আজ সরকারি প্রতিষ্ঠান যা বিনষ্ট করতে উদ্যত।

আফসানা বেগম কথাসাহিত্যিক