‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ওভার ক্যাপাসিটি সমস্যার মাত্রা বেড়ে গেছে এবং তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ওভার ক্যাপাসিটি সমস্যার মাত্রা বেড়ে গেছে এবং তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’

যে কারণে চীন চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদনে ঝুঁকছে

সম্প্রতি বেইজিং সফরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন তাঁর চীনা প্রতিপক্ষদের বেশ সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, চীনা ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় ভর্তুকি দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত বিকল্প জ্বালানি ও বৈদ্যুতিক যানের (ইলেকট্রিক ভেহিকেলস, সংক্ষেপে ইভিএস) মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে ওভার ক্যাপাসিটির (চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য উৎপাদন) দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ইয়েলেন দাবি করেছেন, এটি চীনা কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে, যা চীনা ব্যবসায়ীদের আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে সক্ষম করে তুলছে। চীনের ওভার ক্যাপাসিটি সমস্যার কথা ইয়েলেন ঠিকভাবে উল্লেখ করেছেন, এটা সত্যি। কিন্তু সরকারি ভর্তুকিকেই তিনি যেভাবে সমস্যার মূল কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন, তা ভুল।

চার দশক ধরে অভাব থেকে প্রাচুর্যের দিকে উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে আমার প্রজন্মের চীনা জনগণের একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকেও চীনে সবকিছু রেশনের মাধ্যমে পাওয়া যেত। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্য বা অন্যান্য পণ্য পাওয়া চীনাদের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু আজ সেখানে সহজে পাওয়া যায় না, এমন কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন।

চীন একাই যে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, এমনটা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান একই রকম রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। কয়েক দশক ধরে রপ্তানিকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে তার শিল্প বিনির্মাণ ও বিকাশে সক্ষম করে তুলেছিল। কিন্তু এক দশকের তেলসংকটের ধাক্কার জেরে ১৯৭১ সালে ব্রেটন উডস ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঘটনা জাপানের কোম্পানিগুলোকে অভ্যন্তরীণ বাজার ও স্থানীয় ভোক্তাকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধির দিকে আলোকপাত করতে বাধ্য করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ওভার ক্যাপাসিটি সমস্যার মাত্রা বেড়ে গেছে এবং তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে চীনের অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির ১৭ শতাংশ দখল করে আছে এবং চীন বিশ্বে উৎপাদিত মোট পণ্যের ৩৫ শতাংশই উৎপাদন করে থাকে।

রপ্তানি ঐতিহাসিকভাবে এই ভারসাম্যহীনতাকে ঠিক করার কাজটি করে থাকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার মুখে চীনা রপ্তানিকারকদের ক্রমবর্ধমানভাবে পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।

চীনের আজকের এই বিশাল শিল্পক্ষমতার মূলে রয়েছে দেশটির সঞ্চয়প্রবণ সমাজ। দুই হাজার বছর আগে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও চীনারা সব সময়, বিশেষ করে যেকোনো কঠিন সময়ে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অটুট রাখার শক্তিশালী চেতনা বজায় রাখে। যথাযথ সুরক্ষাবেষ্টনী গড়ে তোলার জন্য তারা সরকারের ওপর নির্ভর করার বদলে ভবিষ্যতের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেরাই নিজেদের রক্ষায় সচেষ্ট হয়।

চীনের আজকের এই বিশাল শিল্পক্ষমতার মূলে রয়েছে দেশটির সঞ্চয়প্রবণ সমাজ। দুই হাজার বছর আগে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও চীনারা সব সময়, বিশেষ করে যেকোনো কঠিন সময়ে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অটুট রাখার শক্তিশালী চেতনা বজায় রাখে। যথাযথ সুরক্ষাবেষ্টনী গড়ে তোলার জন্য তারা সরকারের ওপর নির্ভর করার বদলে ভবিষ্যতের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিজেরাই নিজেদের রক্ষায় সচেষ্ট হয়।

চলমান অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় চীনের নীতিনির্ধারকেরা সেই স্বনির্ভরশীল চীনা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই অনুসরণ করছেন বলে মনে হচ্ছে। এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা না বাড়ার কারণে কোভিড মহামারির মন্দা থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি খুব একটা বেগ পায়নি।

এ ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে স্থানীয় সরকারগুলোকে প্রণোদনা দিলে তা সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক চাঞ্চল্য আনতে পারত। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষের কৌশল হলো, স্থানীয়-সরকারের ঋণ নেওয়াকে সীমিত করে দেওয়া এবং কঠোরভাবে বাজেট নিয়ন্ত্রণকে বাধ্যতামূলক করা।

চীনের জাতীয় সঞ্চয়ের হার ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে প্রায় ৩৫ শতাংশ ছিল। প্রচণ্ড গতিশীল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের বদৌলতে তা ২০১০ সালে ৫২ শতাংশে এসে পৌঁছায়। যদিও তা কমে এখন ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যার পরিমাণ ৭৯ লাখ কোটি ডলার। এই বিপুল পরিমাণের সঞ্চয় দেশীয় বিনিয়োগের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা অর্থনীতির বর্তমান ওভার ক্যাপাসিটির ভিত্তি তৈরি করেছে।

এই সঞ্চয়ের অর্থ উদ্ভাবনভিত্তিক ব্যবসার দিকে পরিচালনা করতে পারে এমন একটি প্রাণবন্ত পুঁজিবাজার না থাকার কারণে সমস্যাটি আরও বেড়েছে। চীনের মোট সামাজিক অর্থায়নের ৭০ শতাংশেই ব্যাংকের অর্থায়নের প্রাধান্য রয়েছে এবং ব্যাংকগুলো উদ্ভাবনী উদ্যোগে অর্থায়ন করতে নারাজ। মোক্ষম পুঁজিবাজারের অভাবে বিকল্প জ্বালানি, ইভিএস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সম্ভাবনাময় বাজারে বিনিয়োগ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এটি চীনকে ওভার ক্যাপাসিটির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

● ইয়াং ইয়াও পিকিং ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চ অ্যান্ড ন্যাশনাল স্কুল অব ডেভেলপমেন্টের লিবারেল আর্টস চেয়ার প্রফেসর

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত