২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ র্যাবের ওপরে স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ উপলক্ষে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মূল বক্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার জবাবদিহির আওতায় আনাকে উৎসাহিত করে।
এ জন্য কয়েকটি দেশের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দেওয়া হয়। এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সন্ত্রাস ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়ায় যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ জানান।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্যোগ নিয়েও যুক্তরাজ্য পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে আল–জাজিরা ৬ ডিসেম্বর ২০২২ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে পরপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে তারা একসঙ্গে কাজ করবে।’
নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী কর্তৃক নিয়োজিত লবিকারী টবি ক্যাডম্যানকে দোহাই দিয়ে ওই একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তি না থাকলে সরকার সাধারণত নিষেধাজ্ঞা দেয় না। কিন্তু টবি ক্যাডম্যান বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে তাদের কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য বা জবাব চাওয়া হয়নি। জনাব আশরাফুজ্জামান উল্লেখ করেন, যে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেই একই সাক্ষ্যপ্রমাণ যুক্তরাজ্যকেও পাঠানো হয়েছিল।
আল–জাজিরার এ প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ব্রিটিশ লেবার পার্টির সংসদ সদস্য ক্রিস ব্রায়ান্ট সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। সন্তুষ্টচিত্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন মেনে নেওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গের নিষেধাজ্ঞা আরোপে যোগ না দেওয়ায় ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা করেছেন কনজারভেটিভ পার্টি থেকে লেবার পার্টিতে যোগ দেওয়া এই সংসদ সদস্য।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৪৫ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের বছর ১৯৮৯ পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মাত্র দুবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নব্বইয়ের দশকে অনেকগুলো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এ জন্য এই দশককে জর্জ লোপেজ নিষেধাজ্ঞার দশক বা স্যাংশনস ডিকেড দশক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুই মেরুর পৃথিবী থেকে এককেন্দ্রিক পৃথিবীর যাত্রা শুরু হয় এই দশকে। এর ফলশ্রুতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা বাড়তে থাকে।
নিষেধাজ্ঞা কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে, এমন তথ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে করা কোনো গবেষণায় কখনোই উঠে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ, কিউবার ওপর ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা এবং চিকিৎসাসেবায় কিউবা অনেক ধনী রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বিবিসি বাংলার খবর বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে।
নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষিত লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে কোনো দেশের আগ্রাসন প্রতিরোধ করা, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার সুরক্ষা, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করা, নিরস্ত্রীকরণ, যুদ্ধরত দেশগুলোকে শান্তি আলোচনায় আনা প্রভৃতি।
বিখ্যাত দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। তার প্রবন্ধটির নাম ‘এ ফিউ ওয়ার্ডস অন নন-ইন্টারভেশন’। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ব্রিটেন অন্য দেশের মতো সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্য নিয়ে হস্তক্ষেপ করে না। বরং ব্রিটেনের হস্তক্ষেপ দুনিয়ার মঙ্গল, বিবাদের মীমাংসা, সভ্যতার আলো ছড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি মহতী কাজের জন্য হয়ে থাকে।
অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ এ কথা বিশ্বাস করবে না। ওই একই প্রবন্ধে জন স্টুয়ার্ট মিল হস্তক্ষেপ–সংক্রান্ত তিনটি সাংঘর্ষিক নীতির মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার বাস্তবসম্মত উপায় বাতলে দিয়েছেন। এ নীতিগুলো হলো মৌলিক মানবিক মর্যাদা ও কল্যাণ সুরক্ষিত করার জন্য বিশ্বজনীন অঙ্গীকার, জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গীকার এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের প্রয়োজনীয়তা।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশের মোট ১২ জন সরকারি কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। দেশটির আইন অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত এই ১২ জন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার পাবেন না। মনে রাখতে হবে, এ নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত, জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত নয়। তবে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঘোষিত উদ্দেশ্য কোনো না কোনোভাবে মানবাধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা দেখেছি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করেছেন।
এ বছরের ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পুলিশ প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে (ইউএনসিওপিএস) তিনি যোগদান করেন। এ বছর এটি ছিল তৃতীয় সম্মেলন, যার প্রতিপাদ্য হলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুলিশিংয়ের যূথবদ্ধ শক্তি ও ভূমিকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা এবং সবার জন্য উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করা।
নিষেধাজ্ঞার ঘোষিত উদ্দেশ্য যত মধুর শোনাক না কেন, এর অঘোষিত ও আসল উদ্দেশ্য ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেয়ে নিজেদের স্বার্থটাই মুখ্য। জোসেফ স্টিগলিৎস লিখেছেন, ‘আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে নতুন এক ঠান্ডা যুদ্ধে প্রবেশ করেছে। আর এ বিরোধকে মার্কিন নেতারা গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের লড়াই হিসেবে চিত্রিত করছেন, যা কিনা সততার পরীক্ষায় ফেল করবে, বিশেষত যখন একই নেতারা সৌদি আরবের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।
এ রকম কপটতা আংশিকভাবে তাদের বৈশ্বিক আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলে, মূল্যবোধকে নয়।’ যুক্তরাষ্ট্র তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতাকে না দেখার ভান করে, আবার কারও ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতন্ত্রহীনতার কিছু সত্য, তার চেয়েও বেশি অসত্য তথ্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়।
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বাংলাদেশকে চীনবিরোধী সামরিক জোট কোয়াডে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে স্যাংশন আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য কোয়াডের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এ জোটকে না সামরিক, না চীনবিরোধী বলে উল্লেখ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ অক্টোবর ২০২২ অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২০০৪ সালে র্যাব যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তারা এ প্রতিষ্ঠানকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। পাশাপাশি তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে অখুশি কি না। তবে আমাদের এ–ও মনে রাখতে হবে, আমাদের পুলিশি ব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি হয়েছিল।
তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থায় পুলিশকে দমন–পীড়নমূলক নানান কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্নল্ড একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ব্রিটেনে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এ পুলিশি ব্যবস্থা ব্রিটিশ নাগরিকদের ক্ষেত্রে সহিংস আচরণ করেনি। কিন্তু আয়ারল্যান্ড বা দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা পুলিশকে সহিংস হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাবের জন্ম হয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার দায় আমাদের নিতে হবে, তবু বলতে হয় পশ্চিমা বিশ্ব এখনো আমাদের এসব কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে আমরা সেই ইঙ্গিত পাই। একইভাবে বলতে হয়, পশ্চিমারা মানবাধিকারের নীতিগুলোকে সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ করে না। মার্কিন নাগরিকদের জন্য এক রকম ব্যবস্থা, ভিনদেশিদের জন্য আরেক রকম ব্যবস্থা। আবু গারিব কারাগার কিংবা গুয়ানতানামো বে বন্দিশালায় মার্কিন সৈনিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তাদের কপটতার উজ্জ্বল সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা কখনো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে, এমন তথ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে করা কোনো গবেষণায় কখনোই উঠে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ, কিউবার ওপর ৬০ বছরের অধিক সময় ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। শিক্ষা এবং চিকিৎসাসেবায় কিউবা অনেক ধনী রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে গেছে। বিবিসি বাংলার খবর বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করেছে।
বাংলাদেশও নিষেধাজ্ঞার এ ভূরাজনীতি সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান