সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল? এ দেশ কি তবে তার ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও দরকারি ভাবতে শুরু করেছিল? এই তরুণেরা কি তাদের অব্যক্ত, বলতে না–পারা জরুরি কোনো চাওয়াকে ভাষা দিয়েছিল? এ লেখায় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন আলতাফ পারভেজ
প্রায় বুড়ো বয়সেও প্রায় প্রতিদিন পাবলিক বাসে চড়ি। চড়তে হয়। সেই কবে শৈশবে ঢাকায় এসে এ জীবনে ঢুকেছি। শ্রেণি উত্তরণ হয়নি! নিত্যকার এ চলাচল ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর, কিন্তু নিম্নবিত্ত জীবনে বিকল্প কী আছে আর।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাবলিক বাসের সংখ্যা ও ভিড়—দুটিই বেড়েছে রাজধানীতে। ভাড়াও বেড়েছে হু হু করে। মনে পড়ে, মতিঝিল থেকে মহাখালী কলেজে দেড় টাকায় যাওয়া যেত। শিক্ষার্থী হিসেবে ৭৫ পয়সা দিলেও হতো। এখন এসব গল্পের মতো।
তবে সবই তো অতীত হয়ে যায় না। অতীতের ভেতর বর্তমানও থাকে। অনেক গল্প গতিশীল নদীর মতো ভবিষ্যতের দিকে চলছে। পাবলিক বাসে চড়ে বড় পাওয়াও আছে জীবনে। সমাজকে এর ভেতরে দেখতে পাওয়া যায়। সমাজকে বোঝার হাজারো রসদ থাকে সেখানে।
বলা যায়, পাবলিক বাস যেন এক ‘উলঙ্গ সমাজ’। কোন মৌসুমে, কোন কারণে নগরবাসীর মুড কেমন থাকে, দেশ-বিদেশের চলমান ঘটনাবলিতে সমাজ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, কোন সপ্তাহে কোন বিষয় সমাজকে আলোড়িত করছে—সবকিছুর অনেকখানি আঁচ-অনুমান বাসের ভেতর মেলে।
তীব্র শীত-গ্রীষ্মে তুমুল ভিড়ে হ্যান্ডল ধরে ঝুলতে থাকা মানুষগুলো কিন্তু সামাজিক অনেক বিষয়ে রসিকতা করতে ভোলে না। থাকে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি—তাতে আশপাশের আদিম সাড়া বা নীরবতা, ঝগড়া, মারামারি। সব মিলে পাবলিক বাস সমাজের অস্বচ্ছ আয়নার মতো। যে দেখতে জানে, বুঝতে চায়, যাদের নজরে জোর থাকে, তাদের জন্য এটা নিত্যদিনের সেরা সংবাদপত্র।
যারা বহুকাল এ রকম পরিবহনের যাত্রী, তাদের কাছে নাগরিক শ্রেণি সম্পর্ক, নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিবর্তন, দশকওয়ারি পোশাক-আশাকের পাল্টে যাওয়াসহ অনেক বিষয় মুখস্থ ব্যাপার। সেই আমার চিরচেনা পাবলিক বাসগুলোর ভেতরকার পরিবেশ ১০ দিন ধরে অনেকটা পাল্টে গেছে। এতটাই বদলেছে যে চমকে ওঠার মতো। আঁতকে ওঠার মতো। জানি না, আমার মতো অন্যদেরও এই নীরব পরিবর্তন নজর কেড়েছে কি না।
ঝগড়া প্রায় নেই। কথাবার্তা একদম কম। কেউ কারও দিকে তেমন তাকাচ্ছেও না। মানুষের মুখ মলিন। বিষাদে পাণ্ডুর। সকালেও, বিকেলেও। আগের মতো বাসের ভেতর চিৎকার করে করে ফোনে কথা বলাও কমে গেছে। কাউকে কথা বলে কিছু বোঝানোর সভ্যসীমা যেন আর নেই বাংলাদেশে!
হঠাৎ করেই যেন মানুষগুলো তাদের পাঁজরে তীব্র ব্যথায় নুয়ে থাকতে শুরু করেছে। কী যেন গভীর ধন হারিয়ে ফেলেছে তারা সবাই। অনেকের হাতে খামচি দিয়ে ধরে থাকা কোনো দৈনিক। যখনই সিট পাচ্ছেন, পেপারটা একটু খুলতেই চোখ-মুখ-চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
জুলাইয়ে কারফিউ শিথিলের পর থেকেই এ রকম দেখছি। কারফিউর আগে-পরের ফারাকটা মোটাদাগের। না বুঝে পারা যায় না, কেন এই গভীর শোকের ভার।
বায়ান্ন দেখিনি। একাত্তরের ঢাকাও দেখিনি। ১৯৯০ সালের আগের বছরগুলোর কথা মনে আছে কেবল। ক্যাম্পাসগুলোয় সামরিক সরকারের গুলি ও কারফিউর ঘটনায় বাসের ভেতরটায় তখন যাত্রীদেরও দেখতাম উত্তপ্ত। ঘটনার অনেক অজানা, না-শোনা বিবরণ পাওয়া যেত সেখানে। কিছু অনুমান ও গুজবও মিলত।
বিবিসিতে আতাউস সামাদ ও ভয়েস অব আমেরিকায় গিয়াস কামাল চৌধুরী কী বলছেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলত বাসের ভেতর। বিটিভি আজকের মতোই তখনো আলোচনায় আসত না। বাড়িতে গিয়ে বিবিসির সন্ধ্যার বুলেটিন শোনার তাড়ায় বাসের চালককে জোরে চালাতে বলা হতো সমস্বরে। সে সময়ও শোক চরাচরজুড়ে এতটা বিষাদ হয়ে জনসমাজকে কাবু করতে দেখিনি; কেবল ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারির দিনগুলো ছাড়া।
কিন্তু এবার আর মানুষ শোককে শক্তি বানাতে পারছে না। মাতম করার জন্য দেহ তার নড়তে পারছে না। এত শোক বওয়ার মতো প্রস্তুতি সমাজের ছিল না যেন। যেন তারা ভাবেনি, কখনো বায়ান্ন, একাত্তর, নব্বই পেরিয়ে আসা দেশকে এত তরুণ, তাজা প্রাণ হারাতে হবে চোখের পলকে।
সন্তানেরাই মাতা–পিতার লাশ বয়ে নিয়ে যাবে, এটাই প্রকৃতির সাধারণ প্রথা। এর ব্যতিক্রমও হয়। কিন্তু এবার এত বিপুল ব্যতিক্রম হলো যে অভিভাবক–সমাজ বিমূঢ়। অতীতে আর কবে এত মা-বাবা একসঙ্গে এত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এত সন্তানকে নিয়ে গোরস্তানে গেছে?
বাংলাদেশ তাই স্তব্ধ। নির্বাক। হয়তো গোরস্তানগুলোও তা–ই।
সংবাদমাধ্যমের হিসাবে মরেছে কয়েক শ তরুণ-যুবা-ছাত্র-জনতা। সেই হিসাবে স্বজন হারানোর বেদনায় থাকার কথা কয়েক শ পরিবার ও তাদের নিকটাত্মীয়দের। কিন্তু নিত্যদিনের বাসের ভেতরটা জানাচ্ছে, বিশাল ঢাকার লাখ লাখ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের বুকের গহ্বরে হাহাকারের সাগর বইছে। সবাই যেন নিজেদেরই কাউকে হারিয়ে ফেলেছে। হারানো মানুষগুলো শেষ পর্যন্ত যেন এ দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে দিল অদেখা এক অনন্ত জানাজায়।
আশপাশের যাত্রীদের মুখ দেখি আর জানালার পাশে বসে স্তব্ধ হয়ে ভাবি, নিহত ছাত্র-তরুণদের কেন এত মায়া করত মানুষ? এই শহরের জনসমাজের কাছে তাদের বিদ্যাপীঠগুলো নিয়ে তবে কি ভরসার কোনো ব্যাপার ছিল?
আবু সাঈদের টিউশনির গল্প বা মুগ্ধদের কাজ করে টাকা কামাইয়ের কাহিনি ইট-সিমেন্ট-ইস্পাতে মোড়ানো এই শহরে এত নিজেদের গল্প হলো কেন? এটা কি তবে কোনো এক বোবাশ্রেণির শোকও বটে, যার তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থ অর্থনীতির অধ্যাপকও। কিন্তু চরম পুরুষালি সমাজ হওয়া সত্ত্বেও এ শহর হয়তো ক্যাম্পাসে নিপীড়িত ছাত্রীদের আহাজারি শোনার মতো নির্বিকার ছিল না।
এ দেশ কি তবে তার ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও দরকারি ভাবতে শুরু করেছিল? এই তরুণেরা কি তাদের অব্যক্ত, বলতে না পারা জরুরি কোনো চাওয়াকে ভাষা দিয়েছিল? সে জন্যই কি দুঃখের এই দিগন্তজোড়া কাঁপুনি?
গুজবের শহরে চলতে-ফিরতে এসব ভাবি আর পরের দিনের ইন্টারনেটহীন জীবনের কথাও মনে আসে। যোগাযোগ করতে না পারায় কত কাজ জমে যাচ্ছে! একটা স্বাধীন দেশে ভিপিএন দিয়ে চুরি করে দেশ-বিদেশের বন্ধুদের খোঁজ নেওয়ার অপমানের কথাও মনে আসে। বাস থেকে নেমে বাড়ি ফেরার পথটুকুতেও হয়তো জবাবদিহি করতে হবে, ‘কে আমি? কোথায় যাচ্ছি?’ স্থানে স্থানে এমন জিজ্ঞাসার জন্য মানসিক প্রস্তুতির কথা ভেবে রাখতে হয় বাসেই।
এরই মধ্যে হৃদয় ছুটে চলে সেসব পরিবারের কাছে, যাদের কেউ গুলিবিদ্ধ। যারা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। মেডিকেলের প্রফেসর বন্ধুর কাছে শুনেছি, ২০ না পেরোনো আহত অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হতে পারে। চিকিৎসকেরা নাকি একসঙ্গে এত গুলিবিদ্ধ ও নির্মমভাবে আহত মানুষ দেখেনি। হাসপাতালে হাজার হাজার অভিভাবকের কান্না আর অসহায়ত্বে চিকিৎসকেরাও বিহ্বল।
যন্ত্রণার অবশ্য এখানেই শেষ নয়; অনেক পরিবার সুস্থ শিক্ষার্থীকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ক্যাম্পাসে কোথায়, কার সঙ্গে ছবি উঠেছে, এটাও এখন পরিবারে পরিবারে মহা আতঙ্ক। তরুণ-তরুণীদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। বাসে এখন আর হাফ ভাড়ার ক্যাচালও হয় না তাই।
লাখ লাখ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন পেছাচ্ছে। তাদের আগের ব্যাচ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় আটকে আছে। অনেকেই ভর্তিপ্রক্রিয়ার মধ্যে এখন ঘরবন্দী। কবে তারা শ্রেণিকক্ষের দেখা পাবে, সেটা অনিশ্চিত। এ রকম লাখ লাখ কিশোর-তরুণকে নিয়ে অভিভাবক–সমাজ অবর্ণনীয় অনিশ্চয়তায় ধুঁকছে। এই অনিশ্চয়তা যে সাময়িক নয়, সেই উপলব্ধি সংক্রামক হয়ে শহর থেকে গ্রামেও ছড়াচ্ছে লাগাতার বিক্ষোভ হয়ে।
বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত নগরবাসী টেনেহিঁচড়ে চলছিল এত দিন। কিন্তু রক্তাক্ত জুলাই অবিশ্বাস্য এক বজ্রপাতে তার সামনের দিনগুলো থেকে প্রায় সব আলো কেড়ে নিয়েছে। এ যেন আজও তৈরি হয়নি, এমন এক ভৌতিক সিনেমার মতো। যেখানে চারপাশের সবাই সম্মিলিত বেদনাভারে বিপন্ন। নতজানু। বিলাপকাতর। কিন্তু কেউ তার শব্দ শোনে না।
এরই মধ্যে চরাচরজুড়ে চলছে ‘স্বাভাবিকতার’ প্রচার। যেন হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ ছেলেগুলো শিগগিরই স্বাভাবিকভাবে আবার শিক্ষাজীবন ফিরে পাবে, যেন কারারুদ্ধ ছেলেগুলোর অভিভাবকদের দুঃখের কিছু নেই, যেন ঘরবন্দী লাখো তরুণ-তরুণীর মন খারাপ করা মুখ দেখে পীড়িত বোধ করার কিছু নেই।
অথচ সত্য হলো, কেবল গ্রাম-শহর নয়, প্রবাসীরাও উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন বললে ভুল হবে, ফোন করে প্রচণ্ড হতাশার কথা শোনায় তারা। তারা কিছু জানতে চায় না এখন আর। জানাতে চায়। কয়েক শ শহীদ তাদের দেশ নিয়ে জানতে চাওয়ার সব ক্ষুধা ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা এখন কেবল জানাতে চায়, এতটা ভবিষ্যৎহীন জীবন নিয়ে তারা বাকি জীবন কীভাবে কাটাবে এবং খাটবে?
‘কোটা সংস্কারের’ আওয়াজের মধ্যে যেন আরও আরও জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও শুনেছিল এসব মানুষ। তারা হয়তো ভেবেছিল, এই তরুণ-তরুণীরা বড় হয়ে প্রকৃতই বাংলাদেশকে পৌঁছে দেবে একাত্তরের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বপ্নে।
কিন্তু সেই স্বপ্নেরা বোবা বিষাদ হয়ে এখন আমার সঙ্গে পাবলিক বাসে। কারফিউর মেয়াদ ফুরানোর আগে তাকে বাসায় পৌঁছাতে হবে। কিন্তু সে ঘুমাতে পারবে না। ছটফট করবে। কোনো সুসংবাদের জন্য। দীর্ঘ এই বিষাদ থেকে মুক্তির জন্য দরকার পরিবর্তনের নতুন ভোর; প্রাণ খুলে দম নেয়ার মতো একটি ভয়হীন ভোর।
আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক