খেলোয়াড়েরা নির্বাচনী রাজনীতিতে এত আগ্রহী কেন

জাতীয় ক্রিকেট দলের দুই খেলোয়াড়। একজন অবসরে আরেকজন এখনো খেলছেন। একজন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আরেকজন একই দল থেকে সংসদ সদস্য হতে চান।
জাতীয় ক্রিকেট দলের দুই খেলোয়াড়। একজন অবসরে আরেকজন এখনো খেলছেন। একজন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আরেকজন একই দল থেকে সংসদ সদস্য হতে চান।

বিশ্বখ্যাত একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার একটা বিশেষ দলের এমপি হতে চেয়ে আন্তর্জাতিক খবর হয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানেও বেশ প্রচার পেয়েছে খবরটি।

যেকোনো দল মানেই তার বিরোধী আদর্শের মানুষ থাকবেন। বাংলাদেশে এ রকম অনেক ক্রিকেট-ভক্ত এই খবরে আহত বোধ করেছেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই এ রকম খেলোয়াড়দের ‘জাতীয় রাষ্ট্রদূত’ ভাবেন। মাঠে তাঁদের পারফরম্যান্সের সঙ্গে নিজেদের জাতীয় মর্যাদার জয়-পরাজয় মিলিয়ে ফেলে আবেগে ভাসেন। অন্য ‘জাতি’কে কটূক্তি করতেও থামেন না।

কিন্তু যখন দেখেন তাঁদের সেই ‘স্বপ্নের নায়কের’ ভাবনায় রয়েছে সবাই নয়—কোনো একটা বিশেষ দল মাত্র—কোন এক এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে ‘জয়ী’ হওয়ার মতো কিছু ভোটমাত্র—তখন একধরনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা হওয়া স্বাভাবিক। সাবেক অনেক ক্রিকেট তারকাকে নিয়েও একই প্রতিক্রিয়া ছিল কয়েক বছর আগে। ভবিষ্যতেও এ রকম হবে অন্য কোনো তারকাদের নিয়ে।

‘স্পোর্টস ক্যাপিটালিজম’ প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে এভাবে নিজেদের পণ্যের ‘জাতীয়’ পরিচয় বানায় এবং নাগরিকেরা সেখানে তাঁদের স্বপ্ন বন্ধক রেখে কষ্টে পড়েন। কিন্তু এই বেদনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও চায়ের দোকানে ‘ট্রল’ বা ঠাট্টা–মশকরা করে থামানো যাবে না। ট্রল রোগের চিকিৎসা নেই। সেটা রাজনৈতিকভাবে মূল্যহীনও বটে। বরং বোঝা দরকার কেন এমন হচ্ছে এবং তাতে দায় কি কেবল খেলোয়াড়দের?

আধুনিক অর্থনীতি ও পুঁজিতন্ত্রের একটা বেশ আদুরে শাখা খেলাধুলা। ‘স্পোর্টস ক্যাপিটালিজম’ এখন রীতিমতো বড়সড় একটা শাস্ত্র। বিশ্বজুড়ে কেবল ক্রিকেটের এক বিলিয়ন ফ্যান আছে বলে আইসিসির দাবি। যাঁদের ৯০ ভাগই দক্ষিণ এশিয়ায়। এই ‘ফ্যান’রা আইসিসির কাছে ‘ভোক্তা’ ছাড়া কিছু নন। ফিফার কাছে ‘ফুটবল-পাগল’রাও তা-ই। সুতরাং ক্রিকেট-ফুটবলের মতো কোন খেলায় ‘তারকা’ হওয়া মানে একই সঙ্গে একজন সুপার রিচ বা মহাধনী হওয়াও বটে।

স্পোর্টস তারকারা যে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী, তা-ও ঠিক নয়। দুনিয়াজুড়ে এই প্রবণতা আছে। কিন্তু এখানে এটা বেশ জোরেশোরে চলছে। খেলোয়াড়েরা তারকা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অবসর নেওয়ার আগেই রাজনীতির ভাবগতিক নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ছেন। খেলোয়াড়ি জীবনের একপর্যায়ে এসে দেখা যায় মাঠ নয়; তাঁদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ‘নেতা’দের সঙ্গ, জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিসভা, মেয়রের অফিস, ‘পার্টি’ কার্যালয়।

একালে প্রায় সবাই সম্পদকেই মর্যাদার মাপকাঠি ভাবেন। এটাই রেওয়াজ। ক্রিকেটারদের সমকালীন সেই ‘মর্যাদা’র কমতি নেই। তারপরও এই অতিধনীরা এমপি-মন্ত্রী-মেয়র হতে চান কেন? রাজনীতিই-বা তাঁদের ব্যাপারে এত আগ্রহী ও উদার কেন? এই ধাঁধার রহস্য কী? এই ‘অপবিত্র’ সম্পর্কের গোড়া কোথায়?

স্পোর্টস তারকারা যে কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী, তা-ও ঠিক নয়। দুনিয়াজুড়ে এই প্রবণতা আছে। কিন্তু এখানে এটা বেশ জোরেশোরে চলছে। খেলোয়াড়েরা তারকা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অবসর নেওয়ার আগেই রাজনীতির ভাবগতিক নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ছেন। খেলোয়াড়ি জীবনের একপর্যায়ে এসে দেখা যায় মাঠ নয়; তাঁদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ‘নেতা’দের সঙ্গ, জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিসভা, মেয়রের অফিস, ‘পার্টি’ কার্যালয়।

ক্রিকেটের কথাই ধরা যাক। ব্রিটেন ক্রিকেট খেলে প্রায় আড়াই শ বছর পেরোল। অস্ট্রেলিয়া দুই শ বছরের বেশি। সেই তুলনায় পুরোনো ভারতবর্ষের বর্তমান তিন দেশে ক্রিকেটের বয়স এক শতাব্দী কেবল। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান ও এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রীড়া তারকারা যে জায়গা পাচ্ছেন, ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়ায় তা সে রকম নয়।

শ্রীলঙ্কাতেও এই জোয়ার বইছে। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিতে বাড়তি মজাটা কোথায়? প্রায় দেড় কোটি ফ্যান আছেন এমন ক্রিকেট তারকাও এখানে এমপি হতে চাইছেন কেন? নিশ্চয়ই জনপ্রিয়তার লোভে এই মাঠের ‘তারকা’রা রাজনীতিতে আসছেন না। ওই ‘দ্রব্য’ তো তাঁদের যথেষ্টই আছে।

এই ধাঁধার উত্তরটা খুঁজে পাওয়া খুব দুরূহ নয় বোধ হয়। ঔপনিবেশিক রাজনীতি ও ক্ষমতার ছকেই আছে আজও দক্ষিণ এশিয়া। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আছে একধরনের বন্য মজা। রাজনীতিতে সংস্কার হলে সেটা থাকত না। সাত-আট দশক আগে দক্ষিণ এশিয়ায় স্বাধীনতা এলেও এখানে ক্ষমতার মজা রয়ে গেছে ব্রিটিশরাজের বদলে স্থানীয় আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির হাতে—জনগণের কাছে নয়। ফলে অতিধনী হয়েও অনেকে তৃপ্ত নন। ‘সফল রাজনীতিবিদ’দের ক্ষমতাচর্চার দিগন্তজোড়া পরিসর দেখে একধরনের শূন্যতাবোধ পেয়ে বসে তাঁদের। মৃত্যুর আগে ক্ষমতার ওই আদিম ধাঁচের মজাটুকুও তাঁদের টানে।

তাঁদের এই আগ্রহে রাজনীতিও মজা পায়। আরও সরাসরি বললে রাজনীতির স্পষ্ট ইন্ধন থাকে। কারণ, এই মহাধনীরা জন–আকাঙ্ক্ষার ভার নিয়ে রাজনীতিতে আসেন না। বরং তাঁদের তৈরি জনপ্রিয়তা কোনো কোনো রাজনীতিকে বন্ধ্যা দশা থেকে মুক্তি দেয়। শ্রমিক বা কৃষক রাজনীতি করে আসা রাজনীতিবিদদের নিয়ে পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু না কিছু অস্বস্তি থাকে। অতিধনীদের নিয়ে সেই অস্বস্তি কম।

পার্লামেন্টে ১০ জন মোহাম্মদ তোয়াহা কিংবা ৫ জন হাজী দানেশ থাকলে বিরাট অস্বস্তি। কিন্তু ফুটবল তারকা ২০ জন থাকলেও দুর্ভাবনা অত নয়। জমিন থেকে উঠে আসারা নিচুতলার নানা চাওয়া নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদে ঢোকেন। কিন্তু আকাশ থেকে নেমে আসা তারকাদের সেই দায় নেই। বরং তাঁরা চলতি রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে প্রকৃত চেহারা আড়ালের নতুন একটা প্রচ্ছদ দেন। আর প্রচ্ছদ বা মোড়কের সঙ্গে ভেতরের মালপত্রের ব্যবধান ট্রল করে কমানো যায় না।

এই বাস্তবতার উপসংহার একটাই—স্বপ্নগুলো ভুল জায়গায় জমা করা ঠিক নয়। বিশেষ করে মুনাফার পণ্য হতে দিলে মুশকিল। তাতে ‘স্বপ্ন’ দফায় দফায় বেচাকেনা হতে থাকে। বহু বছর বেচেন ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপনের মুখ বানিয়ে। তারপর বেচবে রাষ্ট্র—‘জনপ্রতিনিধি’ হিসেবে দেখিয়ে। ক্ষমতাহীনের স্বপ্ন হোক ক্ষমতাবান হওয়ার। স্বপ্ন বেচাকেনার বাজার থেকে মুক্ত হওয়ার।

  •  আলতাফ পারভেজ গবেষক