মতামত

‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ কতটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক

রাজনৈতিকভাবে সঠিক বা পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়াটা একটা জীবনব্যাপী সংগ্রাম। রাজনৈতিক শুদ্ধতা অর্জনের নানা পরত আছে। ব্যক্তি নিজের কাছে হয়তো উত্তীর্ণ হলেন, কিন্তু তাঁকে অন্যের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকতে হয়। আর এই পরীক্ষায় পাশের কোনো সর্বজনমান্য মানদণ্ড নেই আসলে।

রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান—সবই রাজনৈতিক, আর এর অংশীজনেরা হবেন অরাজনৈতিক? সে প্রিন্স হোক কিংবা পপার (রাজা কিংবা ভিক্ষুক), তাঁকে প্রতি পদে রাজনৈতিক শুদ্ধতার পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু ঘোষণা দেওয়া যাবে না? এমন একটা সময় এসেছে, যখন পলিটিক্যাল কারেক্ট বিষয়টি প্রজ্ঞার মানদণ্ড নয়, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে (পলিটিক্যাল কারেক্ট: দ্য ফ্রেইজ হ্যাজ গন ফ্রম উইজডম টু ওয়েপন)।

ভাষা চৈতন্যের সমবয়সী। ভাষা হচ্ছে ব্যবহারিক চৈতন্য, যা সবারই থাকে। দ্য জার্মান আইডিয়লজিতে মার্ক্সস ও এঙ্গেলসের এমন ভাবনা এখনো প্রাসঙ্গিক। যে দর্শন বা ভাবাদর্শ মানুষ বিশ্বাস করে, তার যদি ব্যাপক বিস্তার চায়, তাহলে তা প্রচার করে। সে চায় আরও আরও মানুষ এই ভাবাদর্শের পতাকা বয়ে, তা ছড়িয়ে দিক। এ কথাও সত্যি, যখনই কোনো অনুশাসন বা ইশতেহার তৈরি হয়, তখন থেকেই অবদমনের শুরু নিয়মনিষ্ঠতার (নিয়ন্ত্রণ) শুরু।

মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ—একই উপনিবেশের উত্তরাধিকার, তাই সমস্যাও প্রায় একই রকম। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদের জন্য বিচারপতি এস মুরলীধরের নাম সুপারিশ করে, কিন্তু কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সুপারিশকে না মেনে অন্য এক বিচারপতিকে মাদ্রাজে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করে। কেন্দ্রের তরফে মুরলধীরের বদলিতে সম্মতি জানায়নি। কারণ, দিল্লির উত্তেজনার সময় তিনি নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে আদেশ দিয়ে সংবাদের শিরোনামে এসেছিলেন।

বিচারপতি মুরলীধর আগে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে আদেশ দেওয়ায় এক রাতের মধ্যে তাঁকে দিল্লি থেকে পাঞ্জাবের হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলি করা হয়। এই নির্বাহী পদক্ষেপের জেরে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। দিল্লির হিংসার ঘটনায় এক শুনানিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এই দেশে ১৯৮৪-এর মতো আরেকটি ঘটনা ঘটতে দিতে পারি না।’

এক রাতের মধ্যে বিচারপতি মুরলীধরকে স্থানান্তরিত করার প্রতিক্রিয়ায় দিল্লি বার অ্যাসোসিয়েশন দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে, এই ধরনের বদলি কেবল মহৎ প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকারক নয়, এতে সাধারণ মানুষের বিচারব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। রাজনীতির শিকার জনগণের পক্ষে আদেশ দিয়ে বিচারপতি নিজেই রাজনীতির শিকার।

সবকিছু যখন ভাঙনের মুখে, তখনো নাগরিকদের ভরসার জায়গা বিচারালয়। দেশ–কালনির্বিশেষে বিচার একটি রাজনীতিনিরপেক্ষ ন্যায়নির্ধারণী বিষয়। পূর্ববর্তী রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই থাকুক, বিচারের দায়িত্ব পালনের আগে নিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে বিচারকাজ সম্পন্ন করেন বিচারপতিরা। রাজনৈতিক বিযুক্ততার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয় সব ক্ষেত্রে, কি বিচার প্রক্রিয়ায়, কি বিচার ব্যতীত অপরাপর সামাজিক আচারে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার। বিচারপতি কায়ানি তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন, ‘মামলা, তা রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক হোক, রায় দানের আগে আইনমন্ত্রী বা আইন সচিবের কাছ থেকে একটা গোপন চিরকুট পেতাম। তাতে নির্দেশ থাকত কোন পক্ষকে জয়ী করতে হবে। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও এই চিরকুট পাওয়া বন্ধ হয়নি। এই ধরনের হস্তক্ষেপ যেন ভবিতব্য। এই ঘটনাগুলো উল্লেখ করার কারণ, একই উপনিবেশের শাসনে থাকা দেশগুলোর সাংবিধানিক আদালতের ভাগ্য পরিক্রমা যেন বোঝা যায়।’

জর্জিও আগামবেন তাঁর প্রভাব বিস্তারকারী বই হোমো সাকার: সভ্রেইন পাওয়ার অ্যান্ড বেয়ার লাইফ-এ অনুসন্ধান করেছেন, পাশ্চাত্যের সার্বভৌমত্বের প্রকৃত রূপ ও তার সঙ্গে যুক্ত আইন ও রাষ্ট্রের কাঠামো। আর এই কাজে তিনি ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের থিসিস অন দ্য ফিলোসফি অব হিস্টোরি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন দারুণভাবে। যেখানে দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যতিক্রম ‘স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়’।

তিনি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো ভাঙনের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে এবং এই ব্যতিক্রম কেবল দ্রুততাই পায়নি, একই সঙ্গে সমসাময়িক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-দার্শনিক স্থাপত্যের ভেঙে পড়ার কারণ হিসেবে কাজ করেছে। পাশ্চাত্য যখন ভাঙনমুখী, প্রাচ্যও তাকে অনুসরণ করেছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এর বাইরে কি? বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান না হয় সংগ্রামরত, কিন্তু ন্যায্যতার পুরোহিত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুব উন্নত কি?

ডেমোক্রেটিক আর রিপাবলিকান যে পার্টিই ক্ষমতায় আসুক, বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনীতি বিবেচনায়। ইয়েল ইউনিভার্সিটির স্টার্লিং প্রফেসর ব্রুস একারমেন সংবিধানের দুই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের বিচারপতি মনোনয়নের যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, তার কোনো কারণ খুঁজে পান না।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আদালতে বিভক্তি নতুন কিছু নয়, যেহেতু প্রেসিডেন্ট তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিচারককেই মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। স্ট্যানফোর্ড ল রিভিউতে এরিক হ্যামিলটন লেখেন, সুপ্রিম কোর্টের রাজনীতিকীকরণ মার্কিনিদের আস্থা হারানোর কারণ। যদিও ইংল্যান্ডের বিষয়টি রাজনীতিবিযুক্ত।

বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ বিচারকের ন্যায়বোধ, সততা, সুগভীর জ্ঞান ও অর্জিত প্রজ্ঞার ওপর নিঃশর্তভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে থাকে। আইন ও বিচারসংশ্লেষে এটাই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত রীতি। জনসমাজে প্রচলিত রীতি, ঘটমান রেওয়াজ ও স্বাভাবিক মূল্যবোধের আন্তপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানগুলো চরিত্র পায়।

সবকিছু যখন ভাঙনের মুখে, তখনো নাগরিকদের ভরসার জায়গা বিচারালয়। দেশ–কালনির্বিশেষে বিচার একটি রাজনীতিনিরপেক্ষ ন্যায়নির্ধারণী বিষয়। পূর্ববর্তী রাজনৈতিক বিশ্বাস যা-ই থাকুক, বিচারের দায়িত্ব পালনের আগে নিরপেক্ষতার শপথ নিয়ে বিচারকাজ সম্পন্ন করেন বিচারপতিরা। রাজনৈতিক বিযুক্ততার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয় সব ক্ষেত্রে, কি বিচার প্রক্রিয়ায়, কি বিচার ব্যতীত অপরাপর সামাজিক আচারে।

পরিহাসের মতো শোনায়, আমরা প্রত্যাশা করি, বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা অরাজনৈতিক হবেন, কিন্তু তাঁরা যে আইনের ভিত্তিতে বিচারকাজ করেন, সেই আইন প্রণয়ন করেন রাজনীতিবিদেরা, যাঁরা দলীয় রাজনীতিক। কার্যত বিচারপতিরাই সংবিধানের ‘অতন্দ্র রক্ষী’। ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ উচ্চারণ আমাদের মতো রাজনীতিক কারণে বিভক্ত সমাজে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে পলিটিক্যালি কারেক্ট সমাজে কি একই মাত্রায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত? আমাদের তৎপরতা কি পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়া, নাকি অন্য কিছু? কিথ জে বাইবির বইয়ের শরণ নিই—‘অল জাজেস আর পলিটিক্যাল, এক্সেপ্ট হোয়েন দে আর নট।’

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট