অক্টোবর বিপ্লবের মাস। এই অক্টোবরেই ১৯১৭ সালে ভি আই লেনিনের নেতৃত্বে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। সেই বিপ্লবের কাহিনি নিয়ে সাংবাদিক জন রিড লিখেছিলেন ‘টেন ডেজ দ্যাট শক দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’।
বাংলাদেশেও এরশাদ আমলে ১৯৮৮ সালের অক্টোবরে বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছিল। সেবার এরশাদের পতন না হলেও দুই বছরের মাথায় তাঁকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দল। সেটাও ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন। ১৯৮৮ সালের মার্চে তিনি একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন।
এবারেও নির্বাচন নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলতে গেলে প্রতিদিনই ‘বাংলাদেশ’ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন। বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এবারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। মাঠে-ঘাটে, শহরে-বন্দরে আপনি যেখানেই যাবেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা। দেশের সীমা ছাড়িয়ে দিল্লি, ওয়াশিংটন, লন্ডন, ব্রাসেলস ও বেইজিংয়েও সেই আলোচনা পৌঁছে গেছে।
এই যে দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ১০০ ছাড়াল। ভারী বৃষ্টিতে একের পর এক শহর ডুবে যাচ্ছে। উত্তরে বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। ডলারের অভাবে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। ব্যাংকের তারল্য সংকট ‘মহামারি’ আকার নিয়েছে। প্রবাসী আয় কমেছে রেকর্ড পরিমাণ। এসব নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব মাথা ঘামান না। তাদের কাছে নির্বাচনই সোনার হরিণ। কিন্তু হরিণটি কীভাবে ধরা যাবে, সে বিষয়ে একমত হতে পারছেন না।
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই সংঘাতমুখর। কিন্তু সেই সংঘাতের যে দায় ও ক্ষতি, সেটা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই ভোগ করতে হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের গোঁয়ার্তুমিতে ইতিমধ্যে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর ক্ষতি বাড়ানো ঠিক হবে না। নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসুক। একটা সমাধানে আসুক।
প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদ পরপর নির্বাচন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের মতো নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক, এত মারামারি, এত হানাহানি, এত আন্দোলন-সংগ্রাম আর কোনো দেশে হয় না। নির্বাচন এলে প্রতিবারই একটা ‘যুদ্ধাবস্থা’ তৈরি হয়। মামলা-ধরপাকড় চলতে থাকে। মানুষ মারা যায়। সম্পদ ধ্বংস হয়। আবার সেই ধ্বংসের জন্য একে অপরকে দায়ী করতে থাকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্বাচন সময়মতো হবে। কেউ আসুক না-আসুক তাতে কিছু আসে-যায় না। বিএনপির নেতারা বলছেন, এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন হবে না। আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তাহলে সমাধানটি আসবে কীভাবে?
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে। অক্টোবরেই সেই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেবে বলে নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নেতারা বলেছেন, মাঠ ছাড়বেন না।
মাঠের মালিক কারা। সংবিধান বলছে, মাঠের মালিক জনগণ। তারাই ঠিক করবেন, কে বা কারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একবার ক্ষমতায় গেলে দেয়ালের লিখন পড়তে চান না। বিরোধী দলে থাকতে নেতা-নেত্রীদের আচরণ দেখে মনে হবে, তাদের মতো গণতন্ত্রকামী ত্রিভুবনে নেই। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেই চেহারা বদলে যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এই একটি বিষয়ে চমৎকার মিল আছে। দোষটা আসলে দলের নয়; ক্ষমতার। আওয়ামী লীগের নেতারা যে ভাষায় এখন কথা বলছেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির নেতারাও একই ভাষায় বলতেন।
নির্বাচন ও আন্দোলনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই পক্ষই জনগণের দোহাই দেয়। তারা অতীত ভুলে যান ভবিষ্যৎ দেখতে পান না। বর্তমান নিয়ে বিভোর থাকেন। যারা ‘এক দফার’ আন্দোলন করছে এবং যারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, উভয় পক্ষ জনগণ তাদের সঙ্গে আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু কার সঙ্গে কতটা আছে, সেটা প্রমাণ করার একমাত্র উপায় অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এখানে গোঁজামিল ও চাতুরীর কোনো সুযোগ নেই।
নির্বাচন নিয়ে দুই পক্ষের বাগ্যুদ্ধের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে ভিসা নীতি ঘোষণা করে। এই ভিসা নীতি সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে কিনা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে মাঠের রাজনীতিকে গুণগত পরিবর্তমান এনেছে। আগে বিরোধী দল মাঠেই নামতে পারত না। এখন অন্তত তারা নির্বিঘ্নে সভাসমাবেশ রোডমার্চ ইত্যাদি করতে পারছে।
নির্বাচনী রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনা আছে। কেউ এ পক্ষে, কেউ ও পক্ষে। আবার নেতারা মনে যত যন্ত্রণাই থাকুক বাইরে খোশমেজাজ দেখাতে মরিয়া। ভিসা নীতি জারির পর আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কেউ ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসা নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমরাও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। অতএব, আমাদের ভয় কী? আবার কেউ কেউ বলছেন, ভিসা নীতি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সরাসরি বলে দিলেন, ‘তলেতলে আপস হয়ে গেছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ওয়াশিংটনে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের বৈঠককে ইঙ্গিত করেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। এর আগে সুলিভানের সঙ্গে দিল্লিতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের বৈঠক হয়। সেখানেও নাকি বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রসঙ্গ ওঠে।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক সূত্রে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ওয়াশিংটনের বৈঠককে মধুরেণ সমাপয়েৎ বলা যায় না। বরং বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্র এই বৈঠকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে ফের উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক বললেন, আপস হয়ে গেছে। শীর্ষ নেতৃত্ব বললেন, কেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ। এ অবস্থায় জনগণ কোনটা বিশ্বাস করবে?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি মার্কিন ভিসা নীতির ওপর নির্ভর না করে রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। ছয় দিনব্যাপী কর্মসূচি চলছে। এরপর দুর্গোৎসবের বিরতি দিয়ে তারা কঠোর কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে।
প্রশ্ন হলো রোডমার্চ-সমাবেশের পর সেই চূড়ান্ত কর্মসূচি কী হবে? ঢাকায় মহাসমাবেশ। মহাসমাবেশের পর কী হবে? ঢাকা অবরোধ-ঘেরাও। সরকার সেই কর্মসূচিকে কীভাবে নেবে? তারা কি ঢাকা শহর অবরোধ-ঘেরাও করতে দেবে? যদি না দেয়, তাহলে কী হবে?
বিএনপি এত দিন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে। সরকার বাধা দেয়নি। বাধা দিলে বাধবে লড়াইয়ের মনোভাবই তারা পোষণ করে আসছে।
বিএনপির কঠোর কর্মসূচিকে যে আওয়ামী লীগ বা সরকার সুনজরে নেবে না, সেটা নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিতেই টের পাওয়া যায়। এর আগে বিএনপি ঢাকার প্রবেশপথে যে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল, সেটি ধরপাকড়, নেতাদের ওপর লাঠিপেটা ও মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
নির্বাচন কমিশন আগামী নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কারণেই অক্টোবর ডেটলাইনের বিষয়টি সামনে এসেছে। শেষ অক্টোবরে কী হবে? কে করবে এসপার-ওসপার? অক্টোবর শেষ হলেই বা কী হবে?
বাংলাদেশের রাজনীতি বরাবরই সংঘাতমুখর। কিন্তু সেই সংঘাতের যে দায় ও ক্ষতি, সেটা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই ভোগ করতে হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের গোঁয়ার্তুমিতে ইতিমধ্যে দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আর ক্ষতি বাড়ানো ঠিক হবে না। নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার আগেই রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসুক। একটা সমাধানে আসুক।
নির্বাচনের সংকট নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা সুলিভান ও দোভালের সঙ্গে আলোচনা করতে পারলে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে নয় কেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি