ভূরাজনীতির ছায়ায় নেপালে নতুন নির্বাচন

নেপালের জাতীয় রাজনীতির মূল শক্তি নেপালি কংগ্রেস এবং বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত বামপন্থী দলগুলো।
ছবি : রয়টার্স

আশপাশের দেশগুলোয় নির্বিঘ্ন জাতীয় নির্বাচন হচ্ছে, এটা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য দীর্ঘশ্বাসের কারণ হতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তবতা যে নেপালেও আরেক দফা নির্বাচন হচ্ছে আজ। নতুন নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে পাকিস্তান ও ভারতেও।

অনন্য এক নির্বাচনী ব্যবস্থা

নেপালের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। সেখানে জাতীয় পার্লামেন্টের পাশাপাশি প্রদেশগুলোর জনপ্রতিনিধি সভাও সরাসরি ভোটে গঠিত হয়। এবারও দুটো ভোট একসঙ্গেই হচ্ছে।

জাতীয় ফেডারেল পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২৭৫। এর ভেতর ১৬৫ জন (৬০ শতাংশ) সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। বাকি ১১০ জন (৪০ শতাংশ) দলগুলোকে দেওয়া হবে তাদের সর্বমোট প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হিস্যা অনুযায়ী। নিজ নিজ প্রার্থী মনোনয়নের সময় দলগুলোর জন্য নারী, দলিত, আদিবাসীসহ অনেক জনগোষ্ঠীকে মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। যেমন দলগুলোর জনপ্রতিনিধিদের ভেতর এক-তৃতীয়াংশ নারী থাকতে হয়। তবে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের নিকটাত্মীয় অনেক নারীও এ রকম নারী কোটায় এমপি হতে চাইছেন।

অন্যদিকে, সাতটি প্রদেশে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন সব মিলে ৫৫০ জন। অর্থাৎ কোনো এলাকার জাতীয় পর্যায়ের একজন জনপ্রতিনিধির বিপরীতে সেখান থেকে প্রাদেশিক পরিষদে থাকছেন দুজন প্রতিনিধি। প্রাদেশিক এই প্রতিনিধিদেরও ৬০ ভাগ (৩৩০ জন) সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ৪০ শতাংশ আসন (২২০ জন) যাবে দলগুলোর আনুপাতিক ভোটের হিস্যামতো।

জাতীয় ও প্রাদেশিক জনপ্রতিনিধিরা আবার বিশেষ নিয়মে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৫৬ সদস্য নির্বাচন করবেন (প্রতি প্রদেশে ৮ জন)। প্রতিনিধি পরিষদের ২৭৫ জন এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৫৯ জন (তিনজন প্রেসিডেন্টের মনোনীত) মিলে নেপালের ফেডারেল পার্লামেন্ট।

প্রত্যক্ষ ও আনুপাতিক ভোটপদ্ধতির মাধ্যমে ফেডারেল পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সভা মিলে প্রায় ৮৮০ জন জনপ্রতিনিধি বাছাই হয় নেপালের জাতীয় নির্বাচনে। প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ ভোটার এসব প্রতিনিধিকে বাছাই করেন। প্রত্যেক ভোটার চারটা ব্যালট পেপারে সিল দেন। দুটো ফেডারেল পার্লামেন্টের জন্য; দুটো প্রাদেশিক সভার জন্য। দুই জায়গায়ই তাঁরা প্রার্থী বাছাই করেন এবং পৃথকভাবে দলও বাছাই করেন। এবার প্রার্থীসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে এগারো হাজার। সাত বছর ধরে নতুন সংবিধানের অধীনে নেপালে এই নির্বাহী ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা চলছে। এবার নতুন এই ব্যবস্থার দ্বিতীয় নির্বাচন হচ্ছে।

নেপালের এই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আগ্রহের কথা কাঠমান্ডুতে কোনো লুকানো ব্যাপার হিসেবে নেই। সবাই বলছেন, গণচীন সমাজতন্ত্রী দলগুলোর বিজয় দেখতে চাইছে। এটা অবশ্য বিশেষ কোনো আদর্শিক কারণে নয়। অনেক আগে থেকে তারা কে পি অলি ও পুষ্পকুমার দাহালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই দুজনকে একত্রে রাখতে চীনের রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

দুই জোটে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে

নেপালের জাতীয় রাজনীতির মূল শক্তি নেপালি কংগ্রেস এবং বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত বামপন্থী দলগুলো। এ ছাড়া প্রভাবশালী কিছু আঞ্চলিক দলও আছে এখানে। এ রকম সব দল এবার প্রধানত দুটো জোটের ছায়ায় আছে। এই দুই জোটের মধ্যেই সরাসরি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। একটা জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘ইউএমএল’ নামের কমিউনিস্ট পার্টি। এর নেতা হলেন কে পি শর্মা অলি। এই জোটে আরও আছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি এবং মধেসভিত্তিক জনতা সমাজবাদী পার্টি। অপর এক জোট গড়েছে নেপালি কংগ্রেস ও ‘মাওবাদী’ কমিউনিস্ট পার্টি। এই জোটে আরও কিছু ছোট দলও রয়েছে। শেষের জোটের প্রধান শক্তি নেপালি কংগ্রেস সরাসরি ভোটের ৮৪টি আসনে লড়ছে।

নির্বাচনে অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য

নেপালের এবারের নির্বাচনের অনেক নতুন রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য মরিয়া দলগুলো প্রায় বিপরীত আদর্শের দলের সঙ্গেও জোট করেছে। যেমন কমিউনিস্ট ইউএমএল জোট করেছে হিন্দুত্ববাদী প্রজাতন্ত্র পার্টির সঙ্গে। যেকোনোভাবে সরকারে থাকা দলগুলো মূল রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে নিয়েছে। এটা একই সঙ্গে এ বার্তাও দিচ্ছে যে এককভাবে কোনো দল সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার অবস্থায় নেই। দুটো প্রধান জোটে দুটি বড় সাম্যবাদী দল থাকায় নির্বাচনে এই দুই জোটের ভেতর আদর্শিক বিতর্ক হচ্ছে কম। আবার এই নির্বাচনে আঞ্চলিক কোনো দাবিদাওয়াও প্রবলভাবে নেই।

নির্বাচনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, পুরোনো নেতৃত্ব নিয়ে ভোটারদের হতাশা। তাঁরা একই মুখ দেখে দেখে ক্লান্ত এবং বিদ্যমান দলগুলো তাঁদের আগের মতো আকর্ষণ করতে পারছে না বলেও প্রচারাভিযানে সাক্ষ্য মিলেছে। যেমন তিন দলের প্রধান তিন নেতা শের বাহাদুর দেউবা, পুষ্পকুমার দাহাল এবং কেপি শর্মা অলিকে বহুকাল ধরে তাঁরা জাতীয় রাজনীতির সামনের সারিতে দেখেছেন। এবারও এরাই প্রচারাভিযানে সামনে আছেন।

তৃতীয় নির্বাচনী বৈশিষ্ট্য হলো, স্বতন্ত্র হিসেবে বিপুলসংখ্যক তরুণদের নির্বাচনী লড়াইয়ে নামা। এসব তরুণের ভেতর আছেন প্রচারমাধ্যমের অনেক তারকা সাংবাদিক এবং চাকরি ছেড়ে নির্বাচনে নেমে আসা অনেক নাগরিকও। স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যে বড় দলগুলোর মনোনয়নবঞ্চিত অনেক সংগঠকও রয়েছেন। যেহেতু দলগুলো অধিকাংশ জোটবদ্ধ হয়েছে, সে কারণেই অনেক জায়গায় তারা নিজেদের সংগঠকদের মনোনয়ন দিতে পারেনি। সেসব সংগঠকের মধ্যে যাঁরা জোট ও দলের স্বার্থে নিজের নির্বাচনী সম্ভাবনা ত্যাগ করতে রাজি হননি, তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। গত মে মাসে স্থানীয় নির্বাচনে কাঠমান্ডুতে বালেন শাহ স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নেপালে নতুন দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামার হিড়িক পড়েছে।

স্বতন্ত্রদের এই প্রাধান্য যদি নির্বাচনী ফলেও বজায় থাকে এবং প্রধান দুই জোটের মধ্যে আসনের ব্যবধান যদি অল্প হয়, তাহলে সরকার গঠনে অদলীয় ব্যক্তিরা প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাদের ‘কেনাবেচা’ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে তখন।

নির্বাচনের ফলে থাকবে ভূরাজনৈতিক হিসাব–নিকাশ

নেপালে রাজতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের বয়স বেশি নয়। কিন্তু চলতি ব্যবস্থা নিয়েও নেপালিদের ভেতর হতাশা দেখা যায়। এর মধ্যেও সবশেষ পার্লামেন্ট তার মেয়াদ পুরো করতে পেরেছে। এই লক্ষণ বলছে, নানা সমস্যা সত্ত্বেও দেশটিতে নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় গণতন্ত্র ধীরে ধীরে শিকড় গাড়ছে। একদা সশস্ত্র সংগ্রামে থাকা সাম্যবাদী দলগুলোর প্রধান উপদলগুলোও ক্রমেই নির্বাচনী রাজনীতিকে মূল রাজনৈতিক পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। সাম্যবাদী দলগুলোর অন্তঃকলহের কারণে গত তিন-চার বছরে মধ্যপন্থী নেপালি কংগ্রেসের আবেদন ও প্রভাব বেশ বেড়েছে স্থানীয় সমাজে।

এবারের নির্বাচনে তারা অতীতের চেয়ে ভালো করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত নির্বাচনে তারা ৬৩টি আসন পেয়ে সাম্যবাদীদের চেয়ে অনেক পেছনে পড়েছিল। এবার তারা অন্তত ২০টি আসন বেশি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেপালি কংগ্রেস ও ‘মাওবাদী’দের যৌথ মোর্চা অলির জোটের চেয়ে বেশি আসন পেলে শের বাহাদুর দেউবা বা পুষ্পকুমার দাহাল নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন। যদি বিপক্ষ জোট ভালো করে, তাহলে নিশ্চিতভাবে কে পি শর্মা অলি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হবেন।

নেপালের এই নির্বাচনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আগ্রহের কথা কাঠমান্ডুতে কোনো লুকানো ব্যাপার হিসেবে নেই। সবাই বলছেন, গণচীন সমাজতন্ত্রী দলগুলোর বিজয় দেখতে চাইছে। এটা অবশ্য বিশেষ কোনো আদর্শিক কারণে নয়। অনেক আগে থেকে তারা কে পি অলি ও পুষ্পকুমার দাহালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই দুজনকে একত্রে রাখতে চীনের রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, ভারত নেপালি কংগ্রেস এবং মধেস এলাকার দলগুলোর সফলতা দেখতে আগ্রহী। নেপালের বড় ‘উন্নয়ন সহযোগী’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও আগ্রহভরে এই নির্বাচনে নজর রাখছে।

  • আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক