এ দেশের রাজনীতির মঞ্চে দাপুটে বিচরণ ঘুরেফিরে সেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপিরই।
গত ৪০ বছরের ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, আশির দশকে স্বৈরাচারী এরশাদের জাতীয় পার্টি বছর ছয়েক জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলেও পরবর্তী সময় তাদের জায়গা হয়েছে পার্শ্বচরিত্রে।
এই ভূমিকায় দলটি দেশের রাজনীতিতে অনেক কালো অধ্যায় রচনার সহযোগী হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে।
সময়ের ধারায় পার্শ্বচরিত্রে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের মতো বামধারার দলও।
চলমান রাষ্ট্রসংস্কার–পরবর্তী নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাজনীতির মঞ্চে কারা শাসক আর কারা বিরোধী দলে আবির্ভূত হবেন, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত আন্দোলনের ফসল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’ বাংলাদেশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের চলমান কার্যক্রম নিয়ে নানা মহল প্রশ্ন তুলছে। কিছুটা অসহিষ্ণু সুরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের ‘পথনকশা’ ঘোষণা দেওয়ার দাবি বিএনপির পক্ষ থেকে তোলা হচ্ছে।
আবার কেউ কেউ কপ২৯ সম্মেলনে গিয়ে আল–জাজিরাকে দেওয়া ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারের অপব্যাখ্যা করছেন। বিশেষ করে কিছু সংবাদকর্মী, বিশ্লেষক ও রাজনীতিকদের কেউ কেউ ইংরেজি বক্তব্যের সঠিক অর্থ বোঝার চেষ্টা না করে সেই বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নতুন ইস্যু তৈরির চেষ্টা করছেন। পরাজিত কোণঠাসা পক্ষটির কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাঁদের মুখে। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার না হোক—এমন আকাঙ্ক্ষারও বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এতে। এই অপব্যাখ্যা স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ ফিরিয়ে আনার সূক্ষ্ম কৌশল কি না, তা স্পষ্ট হবে সামনের দিনে।
সংস্কারের নিমিত্তে গঠিত কমিশনগুলো (প্রথমে ছয়টি, পরে আরও চারটি) কাজ শুরু করার পর নানামুখী চাপে এখন বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ করবে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ১৭ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, ‘যাত্রা শুরু করা নির্বাচনী ট্রেনকে সামনে এগোতে এগোতে অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে, এই ট্রেনের শেষ স্টেশনে পৌঁছানো নির্ভর করছে, কত তাড়াতাড়ি রেললাইনগুলো বসিয়ে দেওয়ার ওপর, যা করা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে।’ তাতে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ধারণার চেয়ে কম সময়ে তাদের কাজ শেষ করে বিদায় নিতে চাইছেন। আবার কেউ কেউ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে দেওয়া ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারে তাঁর সরকারের মেয়াদ নিয়েও অপব্যাখ্যা করছেন।
আওয়ামী লীগের পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে পারা না–পারা প্রসঙ্গে ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্য, ‘আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি, কোনো একটি দল কিংবা আরেকটি দলকে বেছে নেওয়ার জন্য আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই।’
ড. ইউনূসের এই কথার সূত্রে বলা যায়, কোনো মাইনাস ফর্মুলা নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন না। রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে একটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। আবার প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন ও জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। নানামুখী চাপে ড. ইউনূস বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘তারা সংস্কার না চাইলে আমরা দিয়ে চলে যাব।’
এদিকে আগের সরকারের রেখে যাওয়া চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমে আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না।
সারা দেশে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজনের অনুপস্থিতিতে জায়গা খালি থাকেনি। অন্য বড় দলটির অসাধু লোকেরা ও দুর্বৃত্ত শ্রেণি চাঁদাবাজি হুমকি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে জনজীবনের শান্তি বিনষ্টের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
‘কত দেবেন বলেন, নইলে আগুন দেব’; ‘আমার নামে এরই মধ্যে ৩৭টি মামলা আছে, আপনারা মামলা করলে হবে ৩৮টি, এসব ভয় পাই না, এখন থেকে এই হাসপাতালের সব সাপ্লাইয়ের কাজ আমাকে দিতে হবে’; ‘দীর্ঘ ১৭/১৮ বছরে আমরা দৌড়ের ওপর ছিলাম। হত্যা, গুম, খুন, গ্রেপ্তার, কারাবাস, জমি–সম্পদ বেদখল। এসবের ফলে আমরা নিঃস্ব। আমাদের ক্ষতি পোষাতে হবে। আপনারা এখন আমাদের পাশে থাকেন, এত দিন যেভাবে (চাঁদা) দিয়েছেন, এখনো সেভাবে (আমাদের) দেবেন’—উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যকার এসব কথা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের। এমন বহু উদ্ধৃতি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, গণ–অভ্যুত্থানের ফসল কীভাবে কারা খেয়ে ফেলছে।
বড় দলটির লোকেরা আবার নিজেরাই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সর্বশেষ গাজীপুরের টঙ্গীতে পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রধান দল ও তাদের যুব সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে। যেমনটি আগে ঘটত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের মধ্যে।
আন্দোলনরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় অভিযুক্ত মহিলা লীগের এক নেত্রীর নাম মামলার চার্জশিট থেকে কাটানোর আশ্বাস দিয়ে জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলা যুবদল সদস্যসচিবের মুঠোফোনের কথোপকথনের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার মতো ঘটনাগুলো তলেতলে ‘রসুনের সব গোড়া এক’ প্রমাণ করছে।
এই নাম কাটানো কিংবা ‘জামিন–বাণিজ্য’ চলছে বিপুল সমারোহে। চট্টগ্রামে ভোল পাল্টে ‘শ্রমিক লীগ’ নেতা হয়ে গেলেন ‘শ্রমিক দল’–এর এবং চলছে থানা থেকে লুট করা অস্ত্রে চাঁদাবাজি।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হওয়া ছাত্র সমন্বয়কেরা বয়সে তরুণ, রাজনীতির নানা ঘোরপ্যাঁচ, ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না আসায় তাঁদের আবেগ্রাশ্রয়ী নানা সিদ্ধান্ত সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরি করছে, প্রায়ই বিএনপির সামনে শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতৃত্বকে।
মাঝে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চেয়ে হার্ডলাইনে গিয়েও পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে তাঁরা নিবৃত্ত হয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পেরেছেন।
এভাবে কোথায় কখন থামতে হয়, এই উপলব্ধি করতে পারার ধারা অব্যাহত থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ করার পথকে মসৃণ করবে।
নিজেদের আসল রূপের ওপর একটা আলখাল্লা পরে আছে সুবিধাবাদী মতলববাজ গোষ্ঠী। মিডিয়ার কল্যাণে ‘কপালে দাগওয়ালা’ একজনকে এখন দেশের সচেতন মানুষ চেনে। ‘বড়দের’ আশীর্বাদে দেশের ইসলামি ধারার অধিকাংশ ব্যাংকের সর্বনাশের কারিগর তিনি ও তাঁর পরিবার।
নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যবৃদ্ধির কারসাজি ঠেকাতে তৎপর সরকারের ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। বিভিন্ন অভিযানে যাঁদের হাতেনাতে ধরা হচ্ছে, তাঁরা সবাই সুরতে-লেবাসে ‘পাক্কা ধার্মিক’। কিন্তু এই লেবাসের খোলস পরে তাঁরা অপকর্ম করে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ।
বিনা পুঁজিতে এই অসাধু চক্র প্রতি ডিমে ৩ থেকে ৪ টাকা, প্রতি কেজি আলুতে ১৫ থেকে ৩০ টাকা মুনাফা লুটছে; কম দামে আমদানি করা আলুও দেশি আলুর সমান দামে বিক্রি করে ক্রেতাদের প্রতিনিয়ত ঠকিয়ে যাচ্ছে এই অসাধু চক্র। যার খেসারত বেশি দিচ্ছেন সীমিত আয়ের, নিম্ন আয়ের মানুষ।
আমদানি করা আলু–পেঁয়াজ দেশি বলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে গিয়ে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তাদের হাতে ধরা খেয়ে বলছেন, ‘বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁরা এ কাজ করছেন।’
মহাপরাক্রমশালী হিসেবে নিজেদের সক্ষমতা ও সামর্থ্য প্রমাণে মাঠে নেমেছে বিএনপি। দেশের এখানে–সেখানে নানা স্থানে আওয়ামী লীগ ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ছেড়ে যাওয়া চাঁদাবাজির উর্বর ক্ষেত্রগুলোয় দখল কায়েম করে ফেলেছে সামনে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা দলটির দুর্বৃত্তরা।
দৈনিক পত্রিকা খুললে কিংবা নিউজ চ্যানেলগুলোয় এসব ‘মহান’ কর্মের খবর আসছে নিয়মিতই। এসব অনুধাবন থেকেই জুলাই বিপ্লবের পরপরই শিক্ষার্থীরা দেয়ালে লিখেছেন ‘নৌকা আর ধানের শীষ, দুই সাপের এক বিষ’।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের চর্চা ক্ষমতালিপ্সুদের খুবই পছন্দের বিষয়। মূল চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে ক্ষমতাচ্যুত গোষ্ঠী আর ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজপথের গোষ্ঠীর মধ্যে তেমন কোনো ব্যবধান নেই। উভয়ের অতীত রাজনীতি ও শাসনামলের ইতিহাস সে রকম সাক্ষ্যই দেয়।
দেশকে ঠিক পথে আনার এখনই সময়। অনেক ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদীদের বিদায়ের পর তরুণ যুবা দেশপ্রেমিক জনগণ সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার চান। চলমান ‘সংস্কার ও রাষ্ট্র মেরামত’ শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষিত হবে। এই প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে তা হলে বাস্তব কারণেই হয়তো ‘দীর্ঘদিনেরÿক্ষতি পুষিয়ে নিতে’ নানা অপকর্মে লিপ্ত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
আরেকটা কথা, চলমান সংস্কার কার্যক্রম চলতে চলতেই মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের আসল চেহারা ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকবে দেশ ও জাতির সামনে। তাতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে ভোটটা কাকে দেবেন, এ মর্মে জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার ধারাবাহিকতায় দেশের ছাত্র-জনতাকে নির্বিচার হত্যা বা গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধের দাবি ওঠায় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, ভোল পাল্টে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত দেশের অপর বড় রাজনৈতিক দলটির।
পরাজিত শক্তির লোকজন ও তাঁদের প্রেতাত্মারা এখন ভর করেছে এই দলের ওপর। এখন তারা কথা বলছে ‘ওদের’ রক্ষা করার নিয়তে! মনে হচ্ছে পরাজিত ও পালিয়ে যাওয়া দলটির ‘বি টিম’ হয়ে কাজ করছে তারা। ‘রাজনীতির এই নতুন খেলা’র মানে বুঝতে একটু ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদের। তা বুঝতে দেরি করলে আবারও পথ হারাবে বাংলাদেশ।
মুহাম্মদ লুৎফুল হায়দার একজন ব্যাংকার