ক্ষুধার সময় ওএমএসের চালের ট্রাক দূরে কেন

আবদুর রবসহ অনেকেই ভোরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন খাদ্য অধিদপ্তরের খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির চাল কিনতে। তবে ট্রাক না আসায় তাঁদের ফিরে যেতে হয় খালি হাতে। রাজধানীর পরীবাগে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

দুই যুগ আগের কথা।

‘বাড়ি পলাতক বালকের মতো’ হুট করে ঢাকায় এসেছি। মফস্বলে কবিতা লিখতাম; মুছতাম। সেই সুবাদে শাহবাগে ‘কবিদের আখড়া’ আজিজ সুপার মার্কেটের নাম মুখস্থ ছিল। সেখানে উঠলাম প্রথম। সেখান থেকে কাজীপাড়ায় এক বাড়িতে। বাড়ির নাম ঝিঙেফুল। সেই বাড়ির দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকে দুই বন্ধু। তাঁদের একজন কবি ও আবৃত্তিকার। আরেকজন ছবি আঁকে। আমিসহ হলাম তিনজন। সে বাসায় রান্না-টান্না হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে তিনজন খেয়ে আসি। নবাগত এই বেকারের খাবারের বিল বাকি দুজন দেয়।

দিন পনেরো পরে ওই দুই বন্ধু কী একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেল। তিন চার দিন পর তাদের ফেরার কথা। কিন্তু ফিরল না। পাঁচ দিন পরও না। ছয় দিন পরও না। এদিকে এই কয়দিন রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমার পকেট ফাঁকা হতে লাগল। বাসায় চাল-ডাল আগে থেকেই থাকত না। অর্থাভাবে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ভাত খাওয়ার বদলে পাউরুটি-চা খাওয়া চলতে লাগল। এক সময় পাউরুটি কেনারও টাকা শেষ হলো।

পকেটে টাকা না থাকলে ক্ষুধা দ্বিগুণ হয়। আমারও খিদে বাড়তে লাগল। কিন্তু বিস্কুট কেনারও টাকা নেই। পরিচিতি কেউ নেই যে ধার নেব। বাসার পাশের মুদি দোকানি তো আমাকে চেনেন না। তাঁর কাছে তাই বাকি চাইতে সংকোচ বোধ হলো। অথচ ক্ষুধা তীব্র হচ্ছে। বারবার পানি খেতে শুরু করলাম। ভাবছিলাম, যে কোনো সময় বন্ধুরা বাসায় ফিরে আসবে, ততক্ষণ পানি দিয়ে চালিয়ে নেব। কিন্তু বন্ধুরা ফিরল না।

খালি পাকস্থলীতে প্রথম বারো তেরো ঘণ্টা কাটানো সবচেয়ে কষ্টকর। তীব্র ক্ষুধার মধ্যে এক লিটার পানি খেলে তাৎক্ষণিকভাবে মাথার ঝিমঝিম ভাবটা চলে যায়। কিন্তু দ্রুত প্রস্রাব পায়। দু-এক বার বাথরুমে যাওয়ার পর মাথা ঝিমঝিম দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে। ঝিমঝিম ভাবটা শেষ পর্যন্ত জ্বরের ঘোরের মতো একটা শিরশির করা ঘোর তৈরি করে।
একবার ভাবলাম, মতিঝিলে যাই। সেখানে এক বড় ভাই থাকে। তার কাছ থেকে কিছু টাকা নেই। পরক্ষণে মনে হলো, নাহ্! কারও কাছে টাকাপয়সা চাইব না।

হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সোবহান সাহেব (আবুল হায়াৎ) খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে ক্ষুধার স্বরূপ বুঝতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতো চরম রোমান্টিসিজম আমার ওপরও ভর করল। আমারও মনে হলো, ঠিক আছে, আমিও ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে চাই। সোবহান সাহেবের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, তাঁর চারপাশে খাবার সাজিয়ে সবাই তাঁকে খাওয়ানোর জন্য জোর করছিলেন; কিন্তু তিনি ইচ্ছা করে উপোস করে ‘ক্ষুধার স্বরূপ’ দেখতে চাচ্ছিলেন। আমার ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো বিষয় নেই। আমার সামনে খাবার নেই। কখন খাবার পাব তার কোনো ঠিক নেই। আদৌ পাব কিনা তাও নিশ্চিত না।

প্রায় ৩৬ ঘণ্টা একটানা পেটে দানা না পড়ার পর আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখা শুরু করলাম। শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করল। প্রথম দিকে যে ক্ষুধার কষ্ট পাচ্ছিলাম, এখন আর তা নেই। এখন মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আসলে ওটা ঘুম ছিল না। ছিল ঘোর। এক অদ্ভুত স্বপ্নালু ঘোর। এটা সম্ভবত অজ্ঞান হওয়ার খুব কাছের পর্যায়। এই পর্যায়ে চোখের সামনে কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট আলো জ্বলতে দেখা যায়। সম্ভবত এটাই ‘সরষে ফুল’।

ঘোরের মধ্যে আমার একটা আধিভৌতিক বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। ব্ল্যাক হোলের মতো কালের গলিত গর্ভে বিলীয়মান সময়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ধীরে ধীরে যেন আমি ডুবে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি...ডুবে যাচ্ছি।
এই ঘোরের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো, কয়েকটা দৈনিক কাগজে তো আমার কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। তারা নাকি বিল দেয়। গিয়ে দেখা যাক না!

আশা মানুষের প্রাণশক্তি ফেরায়। এই আশা আমাকে নিস্তেজ থেকে চাঙা করল। চট করে বাসা থেকে নেমে একটা লোকাল বাসে চেপে একটা দৈনিকের অফিসে গেলাম। সাহিত্য সম্পাদককে নাম বলার পর তিনি চিনলেন। লেখক সম্মানীর কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘অ্যাকাউন্ট সেকশনে যান, বিল রেডি আছে’।

তিনটা কবিতার বিল হিসেবে যদ্দুর মনে পড়ে, মোট নয় শ টাকা আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো। আমার মনে হলো, আমাকে নব্বই হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। টাকাটা হাতে নেওয়ার পর খেয়াল করলাম, শরীরে এখন আর আগের মতো অবসন্ন ভাব নেই। এমনকি ক্ষুধাও উধাও হয়ে গেছে।

একটা ভালো রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। ভালো খাবারের অর্ডার দিলাম। মুখে দিয়ে দেখি, খিদে একেবারেই নেই। আমি খেতে পারছি না। খাবারের গন্ধে আমার বমি আসছে।
আমি খাবার ফেলে বাইরে এলাম। ঝাঁ ঝাঁ চৈত্রের দুপুরে আপাদমস্তক জ্বরের মতো শীতল শিহরণ কেঁপে কেঁপে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যেতে লাগল। মনে মনে বললাম, ‘পরম করুণাময়! ক্ষুধা নামক এই অদ্ভুত অচেনা দানবের স্বরূপ দেখানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এই দানবকে দেখার ভাগ্য সবার হয় না। আমার হয়েছে। কিন্তু এই জিনিস তুমি আর কাউকে দেখিও না।’

প্রথম আলোয় ‘ওএমএসের ট্রাক, চালের জন্য ভোর থেকে অপেক্ষা’ শিরোনামের খবর ও অন্য অনেকগুলো নিউজ পোর্টালে ওএমএসের চাল কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের চাপে এক নারীর মৃত্যুর খবর পড়ে সেই কুড়ি বছর আগের কথা মনে গেল

২.

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় ‘ওএমএসের ট্রাক, চালের জন্য ভোর থেকে অপেক্ষা’ শিরোনামের খবর এবং অন্য অনেকগুলো নিউজ পোর্টালে ওএমএসের চাল কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের চাপে এক নারীর মৃত্যুর খবর পড়ে সেই কুড়ি বছর আগের কথা মনে গেল।

প্রথমোক্ত খবরে বলা হয়েছে, ‘৩০ টাকা কেজির চাল কিনতে টিসিবির ট্রাকের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন মানুষ। কিছু জায়গায় ট্রাক যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।’

আবদুর রব নামের একজন ৭০ বছরের বৃদ্ধ বলেছেন, ফজরের নামাজ পড়ে তিনি রাজধানীর পরীবাগে চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। চার-পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর তিনি দেখলেন ট্রাক আর এল না। তিনি ফিরে গেলেন।

এএমএসের প্রতি কেজি চালের দাম ৩০ টাকা। সঙ্গে থাকে আটা—প্রতি কেজি ১৮ টাকা। একেকজন ক্রেতা পাঁচ কেজি চাল ও চার কেজি আটা কিনতে পারেন। এতে খরচ হয় ২২২ টাকা। বাজার থেকে কিনলে একই পরিমাণ চাল ও আটার দাম পড়ে ৫০০ টাকার কিছু বেশি।

কোলে ১০ মাসের শিশুসন্তান নিয়ে আসা তাসলিমা বেগম বললেন, তাঁর স্বামী ৯ হাজার টাকা বেতন পান। সেই টাকা দিয়ে সংসার আর চলছে না। নিজে পুষ্টিকর খাবার পেটভরে খেতে পারছেন না, তাই শিশুসন্তানও মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে না।

দ্বিতীয় খবরে দেখা যাচ্ছে, গত সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার কলেজ রোড সংলগ্ন রেল বিটের কাছে এক ডিলারের দোকানের সামনে ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড়ের চাপে শিখা মালাকার (৩৮) নামের এক নারী অসুস্থ হয়ে পড়ে যান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে তাঁকে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত মাসে জানিয়েছে, ৬৮ শতাংশ খাদ্য কিনতে লোকজন হিমশিম খাচ্ছে।

এর মধ্যেই সয়াবিন তেল লিটারে ১২ টাকা ও চিনি কেজিতে ১৩ টাকা বেড়েছে। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম এখন ১৯০ টাকা। আর প্যাকেটজাত প্রতি কেজি চিনির দাম ১০৮ টাকা।

আমার মহল্লার একটি বড় মুদি দোকানদার আজ সকালে বলেছেন, যে ডিলার তাঁর দোকানে সয়াবিন তেল সরবরাহ করেন, তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কাছে তেল নেই। আপাতত তেল দিতে পারছেন না। ওই মুদি দোকানদারের ধারণা, তেল ঠিকই আছে। সামনে দাম আরও বাড়তে পারে মনে করে, তেল মজুত করে রাখা হচ্ছে। যত মজুত হবে দাম তত বাড়বে।

অথচ মানুষের আয় তলানিতে নেমে আসছে। নীরবে বহু লোক বেকার হচ্ছে। দুদিন আগে এক আত্মীয় ফোন করে বললেন, তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করেন, সেই কোম্পানি তাঁকে ও তাঁর ২০ জন সহকর্মীকে ছুটিতে থাকতে বলেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এটি ছুটি নয়, এটি ছাঁটাই। চিন্তায় তাঁর গা কাঁপছে। কারণ মাস শেষ হলেই তাঁকে বাসা ভাড়া দিতে হবে। একটি মেয়ে স্কুলে যায়; তার স্কুলের খরচ আছে। একটি দুগ্ধপোষ্য ছেলে আছে। তার জন্য দুধ কিনতে হবে। তিনি এখন কার্যত চাকরিহারা। যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই ‘নো ভ্যাকান্সি’।

বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় পোশাক শিল্প, ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পাট ও পাটজাত পণ্যের কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। ছোট ছোট কারখানাগুলো সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত প্রায় দেড় কোটি শ্রমিক চাকরি হারানোর আতঙ্কে পড়েছেন।

যাঁরা ঢাকা শহরে থাকেন, তাঁরা একটু খেয়াল করলে দেখবেন, তাঁর মহল্লা বা কর্মস্থলের আশপাশে অপরিচিত ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। কারওয়ানবাজারে গত কয়েক দিনে লক্ষ্য করছি, কিছু ভিক্ষুক দেখা যাচ্ছে, যাঁদের চেহারা ও ভিক্ষা চাওয়ার ভঙ্গিমা আলাদা ধরনের। সেই চেহারায় একটা স্পষ্ট লজ্জার আবরণ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ তাঁরা নতুন ভিক্ষুক।

আশার কথা, ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা পাচ্ছেন। ভিক্ষার অভাব এখনো দেখা যাচ্ছে না। অব্যয়ীভাব সমাস অনুযায়ী, ভিক্ষার অভাবকে এক কথায় যা বলে, সে পরিস্থিতি দেশে অন্তত এখনো নেই। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল বৃহস্পতিবার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, সে ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই, কারণ এ বছর ধানে বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে।

মানুষ একদিকে নেতাদের মুখে শুনছে, ভয়ের কিছু নেই; অন্যদিকে খবরে দেখছে, রিজার্ভের ডলার শেষ হয়ে আসছে, আমার ২০ বছর আগেকার পকেটের মতো তার পকেট এবং রান্নাঘরের চালের ড্রামের চাল শেষ হয়ে আসছে। বাচ্চার দুধের কৌটা শেষ হয়ে আসছে।

কিন্তু, মানুষ দেখছে বাজারে ৫৫ টাকার নিচে খাওয়ার উপযোগী চাল নেই, এবং সেই চাল কেনার টাকা জোগাড় করা এখন ভয়ানক কঠিন হয়ে পড়ছে। তখনই সে যে কোনো আশ্বাস বাক্যের মধ্যে আশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা দেখছে। মানুষ না খেয়ে আছে, সে কথা বলা যাবে না। কিন্তু বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতি গত মে থেকে অক্টোবরে সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর প্রভাবে নিম্ন আয়ের মানুষের খাবারের তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাকশ্রমিক ও তাঁদের সন্তানেরা আগের চেয়ে কম খাবার খাচ্ছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকলে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে।

মানুষ একদিকে নেতাদের মুখে শুনছে, ভয়ের কিছু নেই; অন্যদিকে খবরে দেখছে, রিজার্ভের ডলার শেষ হয়ে আসছে, আমার ২০ বছর আগেকার পকেটের মতো তার পকেট এবং রান্নাঘরের চালের ড্রামের চাল শেষ হয়ে আসছে। বাচ্চার দুধের কৌটা শেষ হয়ে আসছে। সাধারণ মানুষ তো হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহি নাটকের সোবহান সাহেব না। তাদের ক্ষুধার স্বরূপ দেখার হাউশ হতে যাবে কেন?

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com