মতামত

প্রধানমন্ত্রীর মানহানি কারা করছে

সোনিয়া আক্তারের ফেসবুক পোস্টটি ছিল এক মাস আগের। আর অভিযোগ দেওয়া হলো গত সোমবার। পরদিন রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ
ছবি: সংগৃহীত

সোনিয়া আক্তার রাজবাড়ী শহর বিএনপির একজন কর্মী। রাজবাড়ী ব্লাড ডোনার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। মাসখানেক আগে তিনি তাঁর দলনেত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কিছু মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেন।

অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় নেতার মনে হয়, তাঁর সেই পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। নেতা সেই ‘আপত্তিকর’ পোস্ট দেওয়ার কারণে থানায় অভিযোগ করেন গত সোমবার রাতে।

পরদিন মঙ্গলবার স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রথম আলোকে জানান, তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবারই পুলিশ দুই শিশুসন্তানের মা সোনিয়াকে গ্রেপ্তার করে গভীর রাতে।

প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে, এ অভিযোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ব্রিটিশদের আমলে করা ফৌজদারি আইনে নারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছু রক্ষাকবচ আছে, কিশোরদের বিচারের ভিন্ন ব্যবস্থা আছে। এদের গ্রেপ্তারের সময় সমতুল্য কোনো নমনীয়তাও দেখানো হচ্ছে না। সাগর-রুনির খুনের তদন্ত ১০ বছরে করতে পারে না যে পুলিশ, প্রধানমন্ত্রীর মানহানির প্রতিটি মামলায় সেই পুলিশ তদন্ত শেষ করছে বিদ্যুৎগতিতে। আদালতে খুনের মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের মামলায় সেটিও দুঃসাধ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এসব নিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পান নিজেরাও মামলায় পড়ার ভয়ে। তারপরও প্রবাসী স্বামীর অবর্তমানে দুই শিশুর এক মাকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বহু মানুষ। তাঁদের মধ্যে বিএনপির সমর্থকেরা আছেন, অন্য অনেকেও আছেন। আমি শুধু ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহর ফেসবুক পোস্টের কিছু অংশের উল্লেখ করছি এখানে। সোনিয়াকে রাজবাড়ীর ‘অত্যন্ত প্রিয়মুখ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত অসংবেদনশীল কথাবার্তা বলেছেন, যা জেন্ডার ইনসেনসেটিভ প্যাট্রিয়ার্কাল ভাষ্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সোনিয়া সেই প্রসঙ্গে বলে থাকলে মোটেও অন্যায় কিছু করেননি।’ বাকী অবিলম্বে সোনিয়াসহ ‘দুঃশাসকদের’ রক্ষাকবচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বন্দী সবার মুক্তির দাবি জানিয়েছেন।

সোনিয়ার ফেসবুক পোস্ট আওয়ামী লীগ সমর্থকদের তারপরও ভালো না–ও লাগতে পারে। এর প্রতিবাদ শালীনতা রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই করা যেত। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু নেতা–কর্মী এটি প্রায় অবধারিত নিয়মে পরিণত করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সামান্য নেতিবাচক কথা বলা হলেও এ জন্য গ্রেপ্তার হতে হবে আবালবৃদ্ধবনিতা—যে কাউকেই। সোনিয়ার ক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের লোকজন এমন অজস্র ঘটনা ঘটিয়ে সরকার ও দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মানসম্মান নিয়ে তাঁরা সত্যি সচেতন হলে এর অনেক কিছু নিজেরাই বন্ধ করতে পারতেন। তাঁরা তা করেননি। গত এক যুগে তাঁরা বরং ব্যক্তিস্বার্থে প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর নাম ও ছবি ব্যবহার করেছেন। তাঁদের নামের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করেছেন, এমন ঘটনা বিরল।

২.

সোনিয়া পরিচিত মুখ হওয়ায় তিনি কী কথার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, তা কিছুটা জানা যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারি না, কার কোন বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি ঘটেছে বলে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা এসব ঘটনার মধ্যে যে বার্তা পাচ্ছি, তা ভয়াবহ।

এসব বার্তার একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাঁরা নিজেরা এই বিশ্বাস বা ভক্তি থেকে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা না করলে সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাঁরা মনে করেন, এটি দেশের অন্য সব মানুষকেও মানতে হবে। কারও বক্তব্যে আসলেই প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হোক না হোক, তিনি নিজে এটি মনে করুন আর না করুন, আওয়ামী লীগের যেকোনো নেতা-কর্মী এটি মনে করলেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। রাষ্ট্রের পুলিশ ও আদালতব্যবস্থায় সরকারের আধিপত্যের কারণে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে এ জন্য বিচারপূর্ব অবস্থাতেই জামিন না পাওয়া পর্যন্ত কারাবাস করতে হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য।

এই অবস্থা ভীতিকর ও চরমভাবে অগণতান্ত্রিক। কয়েক মাস আগে আইনবিদ শাহদীন মালিক বলেছিলেন, সমালোচনা করার ক্ষেত্রে এ দেশে কোনো কোনো লোকের নাম মুখে আনাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাবিদ আনু মুহাম্মদ কিছুদিন আগে বলেছেন, কোনো ভিন্নমত বা সমালোচনা সহ্য না করার এই প্রবণতাই হচ্ছে জঙ্গিবাদ।

আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা অবশ্য নিজেদের নেত্রীর বিষয়ে স্পর্শকাতর হলেও অন্য দলের নেতা–নেত্রীর বিষয়ে যা ইচ্ছা মন্তব্য করার অধিকার আছে বলে মনে করেন। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সম্পর্কে তাঁরা নানা রকম অশ্রাব্য মন্তব্য করেন অনেক সময়। এ জন্য আওয়ামী লীগের কাউকে কোনো আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয় না।

আইনের শাসনের এর চেয়ে বাজে লঙ্ঘন আর কী হতে পারে?

৩.

প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে, এমন মামলাগুলোর মধ্যে আরেকটি বার্তা রয়েছে। সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা মনে করেন, তাঁদের নানা কুর্কীতিতে প্রধানমন্ত্রীর কোনো মানহানি হয় না, মানহানি হয় শুধু অন্য কেউ কিছু বললে। গত এক যুগে বহুবার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, খুনোখুনি, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্রলীগের সীমাহীন অত্যাচার ও নিপীড়নের বহু সংবাদ ছাপা হয়েছে। ইডেন কলেজে যৌন নিপীড়নের ভয়াবহ অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগেরই একদল নেত্রী। দলের নেতার সামনে মারামারির ঘটনা ঘটেছে, খোদ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।

আওয়ামী লীগ আমলে দেশের লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে, শেয়ারবাজার আর ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, সরকারি প্রকল্পে হরিলুট হয়েছে—এমন কিছু কিছু ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাদের নাম এসেছে (যেমন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিতের আমলে শেয়ারবাজার–সংক্রান্ত তদন্তে) সরকারেরই তদন্তে।

আওয়ামী লীগের লোকজন এমন অজস্র ঘটনা ঘটিয়ে সরকার ও দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মানসম্মান নিয়ে তাঁরা সত্যি সচেতন হলে এর অনেক কিছু নিজেরাই বন্ধ করতে পারতেন। তাঁরা তা করেননি। গত এক যুগে তাঁরা বরং ব্যক্তিস্বার্থে প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর নাম ও ছবি ব্যবহার করেছেন। তাঁদের নামের মর্যাদা রাখার চেষ্টা করেছেন, এমন ঘটনা বিরল।

৪.

আওয়ামী লীগের লোকদের মনে রাখতে হবে যে সরকারপ্রধান হলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাজরাজড়ার মতো কেউ নন। তাঁর সমালোচনা করা যাবে না, সংবিধানে এমন কিছু লেখা নেই।

পৃথিবীতে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন বিধান নেই। এ কারণে আমরা ক্ষমতায় থাকাকালেই ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ, আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে বহু সমালোচনা, ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ও প্যারোডি প্রকাশ হতে দেখি। বাংলাদেশে বর্তমানে এটি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বা কাজের সামান্য সমালোচনাও। ফেসবুকে তাঁর সমালোচনাযোগ্য কাজ সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেও মানুষ ‘উগান্ডা দেশে’ বা ‘নাম নেওয়া যাবে না’ এ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দাবলি ব্যবহার করেন।

এমন ভয় নিয়ে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দেননি। এই পরিস্থিতি সৃষ্টিই প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় অবমাননা। এটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেতৃত্ব দেওয়া দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত।

  •  আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক