রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে লক্কর ঝক্কর যান। কোনোটির গায়ে আবার সদ্য রং লাগানো।
রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে লক্কর ঝক্কর যান। কোনোটির গায়ে আবার সদ্য রং লাগানো।

মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাসে রং করবেন?

‘আমি মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাস রং করব’—এই উক্তিটি প্রথম আলো অনলাইনে ২০ মার্চ ২০টা ৫৫ মিনিটে প্রকাশিত খবর থেকে নেওয়া হয়েছে। মাননীয় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই কথা বলেছেন। রাজধানীতে এখনো লক্কড়ঝক্কড় বাস চলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সরকারের গাফিলতির কী আছে? আমি মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাস রং করব?

খবরে আরেও বলা হয়, ‘রাজধানীতে চলাচলকারী লক্কড়ঝক্কড় ও রংচটা কিছু বাসের ছবি নিয়ে কয়েক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। তবে এসব লক্কড়ঝক্কড় বাস চলাচলের বিষয়ে সরকারের কোনো গাফিলতি নেই বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বারবারই বলা হলেও বাসের চেহারা বদলাচ্ছে না। সরকারের গাফিলতির কী আছে? আমি মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাস রং করব?’

মন্ত্রী তাঁর উভয়সংকট পরিস্থিতির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘এসব গাড়ি আমরা বন্ধ করে দিতে পারি। কিন্তু রিপ্লেস (বিকল্প) তো নেই। বাস যখন বন্ধ করে দেব, তখন সাংবাদিকেরাই সবার আগে বিক্ষোভ দেখাবেন। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে, হাজার হাজার মানুষ বাস পাচ্ছে না। আমাদের অবস্থা তো শাঁখের করাত। এটা করলেও দোষ, ওটা করলেও দোষ।’

মন্ত্রীর এই প্রশ্নের জবাব কী হতে পারে। চমৎকার একটা জবাব দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পাঠক। তিনি লিখেছেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী হয়তো জানেন না যে বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাস চলে না আর সেই দেশের মন্ত্রীকেও সেগুলো রং করে দিতে হয় না।

সারা দুনিয়ায় বহু “বাস রুট অপারেটর” কোম্পানি আছে, যাদেরকে দরপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানালে তারা নিজ দায়িত্বে চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক বাস এনে রাজধানীতে অপারেট করবে। সে ক্ষেত্রে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করবে আর রাজধানীতে বাস চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। পৃথিবীর কোন রাজধানী শহরে আমাদের দেশের মতো মোড়ে মোড়ে হাজার হাজার বাসমালিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর দুর্ঘটনা নেই।’

এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে আমাদের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা হলো বিআরটিএ। এটা টিআইবির জরিপে উঠে এসেছে। ‘ব্যক্তিমালিকানার বাস পরিবহন ব্যবসা খাতে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি হয়।

সমস্যা রঙে নয়; সমস্যা যানটির চলাচলের উপযুক্ত কি না—এই প্রশ্নে। তবে বাসগুলোর গায়ে ঘষার দাগ দেখলেই বোঝা যায়, বাসটির চালক কত বেপরোয়া। সে সবকিছুতেই ঘষা দিয়ে যায়। মন্ত্রী যদি একটা বাসে রংও করে দেন, পরের দিনই চালক সেটা গাছের সঙ্গে, দেয়ালের সঙ্গে, আরেকটা বাসের সঙ্গে ঘষা দিয়ে নিয়ে আসবে। এটা কেন হয়, তা বের করা গেলে সমস্যার সমাধান খানিকটা হবে হয়তো।

এর মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলে এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।’
এ বিষয়ে এই প্রশ্নগুলো করা যায়:

১. বিআরটিএ যেসব যানবাহনকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়, সেগুলো কি আসলেই ফিট, নাকি কিছু বাড়তি টাকার বিনিময়ে সেগুলো এই সনদটা পায়?
২. ফিটনেস সার্টিফিকেট যদি লক্কড়ঝক্কড় যানগুলো না পায়, তাহলে কি সেসব রাস্তায় চলতে পারে?
৩. যে চালকেরা ড্রাইভিং লাইসেন্স পান, তাঁরা কি আসলেই ড্রাইভিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ? রাস্তার নিয়মকানুন, জীবনের মূল্য ইত্যাদি বিষয়ে কি তাঁরা সচেতন?
মাননীয় মন্ত্রীকে আর যা যা বলা যায়:
১. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাহারা দেন না। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে চোর ধরেন না।
২. শিক্ষামন্ত্রী স্কুলে স্কুলে গিয়ে পড়ান না বা স্কুলের ঘণ্টা বাজান না।
৩. স্থানীয় সরকারমন্ত্রী পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ডাস্টবিনের ময়লা নিয়ে ট্রাকে তোলেন না।
৪. রেলমন্ত্রী নিজে ট্রেন চালান না।
৫. নৌপরিবহনমন্ত্রী নিজে লঞ্চ চালান না।
তাহলে কী করতে হবে? আইনে যা আছে, তা মেনে চলতে হবে। আইন ১০০ ভাগ চালু করতে হবে।

ঘোষণা করে দিন, রাস্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন ছয় মাস পর আর চলতে দেওয়া হবে না। আজ থেকে ছয় মাস পর রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবেন। লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন বাজেয়াপ্ত করা হবে, জরিমানা হবে, শাস্তি হবে—ঘোষণা দিন।

ঘোষণায় অটল থাকুন। রাস্তা যানবাহনশূন হয়ে গেলে পরের তিন মাসের মধ্যে নতুন যানবাহন এসে শূন্যতা পূরণ করে ফেলবে। কারণ, মুক্ত অর্থনীতি ও প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না।

এই সব সমস্যার সমাধান কী, তা দেখিয়ে দিয়েছে মেট্রো। আমরা যারা মেট্রোয় উঠি, তারা ওঠার সময় একবার, আর নামার সময় একবার করে ধন্যবাদ দিই সরকারকে। সেই ধন্যবাদ নিশ্চয়ই পরিবহনমন্ত্রীও পান। বিআরটি (বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট) চালু হলেও হয়তো সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।

সবশেষে বলা যায়, সমস্যা রঙে নয়; সমস্যা যানটির চলাচলের উপযুক্ত কি না—এই প্রশ্নে। তবে বাসগুলোর গায়ে ঘষার দাগ দেখলেই বোঝা যায়, বাসটির চালক কত বেপরোয়া। সে সবকিছুতেই ঘষা দিয়ে যায়। মন্ত্রী যদি একটা বাসে রংও করে দেন, পরের দিনই চালক সেটা গাছের সঙ্গে, দেয়ালের সঙ্গে, আরেকটা বাসের সঙ্গে ঘষা দিয়ে নিয়ে আসবে। এটা কেন হয়, তা বের করা গেলে সমস্যার সমাধান খানিকটা হবে হয়তো।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক