মরুভূমিতে বসে বড়শি দিয়ে ট্যাংরা মাছ ধরে, সেই মাছ কলমিশাক তুলে রেঁধে খাওয়ার প্রত্যাশা চলে না। কারণ, সেখানে ডোবা-খালের বাস্তবতা নেই। সেখানে বড়জোর দুম্বা চরাতে চরাতে খেজুর কুড়িয়ে খাওয়ার প্রত্যাশা চলে।
তার মানে, ‘প্রত্যাশা’ যুক্তিনির্ভর জিনিস। তার বিচরণক্ষেত্রের নাম ‘বাস্তবতা’। প্রত্যাশার ধরনই বাতলে দেয় বাস্তবতা। আর বাস্তবতা চিরকালই আবেগবিযুক্ত; রূঢ় ও যুক্তিনির্ভর। এই কারণে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মেলে না, এমন প্রত্যাশাকে ঠিক প্রত্যাশা বলে না। সেটিকে বরং কল্পনা বা ‘পাগলের দিবাস্বপ্ন’ বলার চল আছে।
১৩ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এক কর্মশালায় যোগ দিয়ে প্রত্যাশা ও বাস্তবতার সেই ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা অনেকের মতো আমাকেও ভাবিয়েছে। কারণ, কর্মশালাটির শিরোনাম ছিল ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন: প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’। সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে বিশিষ্টজনসহ আমার মতো অবিশিষ্টজনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন–সংক্রান্ত বাস্তবতা কী; সেই বাস্তবতায় সরকার, অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো ও নির্বাচন কমিশনের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য প্রত্যাশা কী হতে পারে এবং নির্বাচন ইস্যুতে ইসির করণীয় কী—এসব নিয়ে সেখানে ইসি বিশিষ্টজনের অভিমত চেয়েছিল। আন্দাজ করি, সেখানে অভিমতের প্রাচুর্য প্রত্যাশার চেয়ে কিছু কম ছিল না।
কর্মশালার শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর অতি সংক্ষিপ্ত স্বাগত বক্তব্যে জানিয়ে দেন, ইসি বিশিষ্টজনের অভিমত শুনতে চায়। ফলে নির্বাচন কমিশনাররা এই আলোচনায় বক্তব্য রাখবেন না, তাঁরা শুধু শুনে যাবেন। তাঁর এই কথায় ইসির সদিচ্ছার প্রতিফলন ছিল। কর্মশালায় খুবই যৌক্তিক কারণে প্রায় সবাই ‘বাস্তবতা’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে সেখানে ‘প্রত্যাশা’ ঠাঁই পেয়েছে সামান্যই।
ইসির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে, ইসির পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব, তা সবাই মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে। তারপরও সিইসির ‘এতটা কাওয়ার্ড হইনি। এতটা নৈতিকতাবিবর্জিত হইনি’—কথাটিকে অক্ষমের ফাঁপা ও সারশূন্য বাক্যের বুদ্বুদ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁর এই উচ্চারণকে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে ভরসার প্রদীপ ভাবতে ইচ্ছা হয়। তাঁর প্রতি প্রত্যাশার পারদ বেড়ে যায়।
বাস্তবতা-১: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের ভাষায়, ‘২০১৪ সালে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনে যাওয়ার পরেও ভোটার ও প্রার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ অনুপস্থিত ছিল। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই ভোট হয়ে গেছে। অনেকের মতে, আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে।’
কিন্তু বিগত রকিবউদ্দীন এবং নূরুল হুদার কমিশন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের একের পর এক ভোটারহীন নির্বাচনকে নির্বিকারভাবে ‘সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক ভোট হয়েছে’ সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে। এ নিয়ে লোকে যথেষ্ট হাসাহাসি করেছে এবং দিন শেষে ক্ষুব্ধ হয়েছে। বর্তমান কমিশন যে সেই দুটি কমিশন থেকে আলাদা কিছু, তা প্রমাণ করার মতো বড় নজির আমাদের সামনে এখনো আসেনি।
বাস্তবতা-২: বড় বিরোধী দলগুলো বলছে, সরকার গদিতে থাকা অবস্থায় ভোট হলে তারা তাতে যাবে না। তারা নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোট চায়। নয়তো তারা ভোট প্রতিহত করতে চেয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে রাজি না। তারা সংবিধান মেনে গদিতে থেকেই ভোট দিতে চায়। গতবারের মতো তারা ‘ভোটার যাক, ভোট থাক’ নীতির পথেই হাঁটছে। ফলে একটা সংঘাতের পূর্বাভাস স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে।
বাস্তবতা-৩: কর্মশালায় সাংবাদিক মাসুদ কামালের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, ‘নির্বাচনব্যবস্থাকে একটি খোঁয়াড়ের মতো বানিয়ে, তাতে সবাইকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হচ্ছে, “তোমরা ঠিক করো কোথায় বসবা, কিন্তু খোঁয়াড়ের বাইরে যেতে পারবে না।”’
বাস্তবতা-৪: কয়েক দিন আগে জামালপুরের জেলা প্রশাসক প্রকাশ্যে বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বলেছেন, ‘এই ডিসিকে দিয়েই আপনাকে নির্বাচন করাতে হবে।’
এই বাস্তবতায় প্রত্যাশার জোর থাকার কথা নয়। আলোচকদের আলোচনায় সেই প্রত্যাশার ঝিলিক খুব একটা ছিলও না। কিন্তু এর মধ্যেও সিইসির বক্তব্য, অভিব্যক্তি ও শারীরিক ভাষায় একধরনের দৃঢ়তা দেখা গেছে। যেহেতু অন্ধকার আদিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যেহেতু নিকষ আঁধারে কুপিবাতির শিখাটুকুই সম্বল, সেহেতু সিইসির তেজোদীপ্ত কথা ও অভিব্যক্তিও অনেক প্রত্যাশা–জাগানিয়া ভূমিকা রাখে।
যেটি ভালা লেগেছে, সেটি হলো সিইসি বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন আমাদের জন্য খুব সহজ নয়। আমরা একটা কঠিন অবস্থায় আছি।....সংকট আছে, আপনারা বলেছেন, আমরাও অনুধাবন করি। সেই সংকট নিরসন করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণের ধারণা, ইসি সরকারকে জেতাতে দস্তখত করে ফেলেছে। এতটা কাওয়ার্ড হইনি। এতটা নৈতিকতাবিবর্জিত হইনি।’
সিইসি বলেছেন, নির্বাচনে কোনো প্রিসাইডিং অফিসার যদি মনে করেন ভোটকেন্দ্র দখল করা হচ্ছে, পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তাহলে তিনি ওই কেন্দ্র থেকে ‘পালিয়ে’ আসতে পারবেন এবং ভোট বাতিল করতে পারবেন। এই এখতিয়ার বিদ্যমান কমিশন প্রিসাইডিং অফিসারকে দিয়েছে। অর্থাৎ অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশের মধ্যেও ভোট কারচুপি বা জোরজবরদস্তি ঠেকানোর মহৎ প্রত্যয় সিইসির মধ্যে লক্ষ করা গেছে।
ইসির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু আছে, ইসির পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব, তা সবাই মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে। তারপরও সিইসির ‘এতটা কাওয়ার্ড হইনি। এতটা নৈতিকতাবিবর্জিত হইনি’—কথাটিকে অক্ষমের ফাঁপা ও সারশূন্য বাক্যের বুদ্বুদ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁর এই উচ্চারণকে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে ভরসার প্রদীপ ভাবতে ইচ্ছা হয়। তাঁর প্রতি প্রত্যাশার পারদ বেড়ে যায়।
তবে ইসির প্রতি আমার সহকর্মী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসানের প্রত্যাশায় খানিকটা বাড়াবাড়িই হয়তো ছিল। তিনি বলেছেন, একটি কেন্দ্রে ভোটে অনিয়ম হলে এবং সেই অনিয়ম অস্ত্র ও পেশিশক্তির মুখে ঠেকাতে ব্যর্থ হলে প্রিসাইডিং অফিসার সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে আসার ও সেই কেন্দ্রের ভোট বাতিল করার এখতিয়ার যেহেতু আছে, সেহেতু সারা দেশের ভোটে অনিয়ম হলে এবং তা ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সিইসিরও সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে।
তবে সোহরাব হাসানের প্রত্যাশার ব্যাপ্তি যতখানি, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার পরিসর হয়তো তত বড় নয়। তাদের প্রত্যাশা, ইসি ছোবল মারতে না পারুক, অন্তত ফোঁস করুক!
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com